Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বহু দ্রোণাচার্যের একক একলব্য

শরণার্থী শিবিরে জন্ম। পেশাগত জীবন শুরু কারখানার শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু তাতে শিল্পবোধ আটকে যায়নি। জীবন তাঁকে লড়তে শিখিয়েছে। আবার শিল্পবোধের জন্মও দিয়েছে। দেখে দেখে কাজ শিখেছেন। শিল্পী অলোক মিশ্রের শরণার্থী শিবির থেকে ঝাড়গ্রাম যাত্রার কাহিনি শুনলেন কিংশুক গুপ্তশরণার্থী শিবিরে জন্ম। পেশাগত জীবন শুরু কারখানার শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু তাতে শিল্পবোধ আটকে যায়নি। জীবন তাঁকে লড়তে শিখিয়েছে। আবার শিল্পবোধের জন্মও দিয়েছে। দেখে দেখে কাজ শিখেছেন। শিল্পী অলোক মিশ্রের শরণার্থী শিবির থেকে ঝাড়গ্রাম যাত্রার কাহিনি শুনলেন কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: শিল্পজগতে প্রবেশ কি আচমকা না প্রস্তুতি ছিল?

উত্তর: কী বলি! রিফিউজি ক্যাম্পে আমার জন্ম। ভয়াবহ দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছি। আচমকা বলা যায়। আবার প্রস্তুতি যে ছিল না সেটাও বলা যায় না।

প্রশ্ন: একটু পরিষ্কার করুন না?

উত্তর: পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আমার মা ও দিদিমা পশ্চিমবঙ্গের ধুবুলিয়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পান। আদ্রার এক রেলকর্মীর সঙ্গে আমার মায়ের বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। মায়ের সতীন ছিল। সেটা গোপন করে বাবা বিয়ে করেছিলেন। মা সেটা মেনে নিতে পারেননি। ফিরে আসেন শিবিরে। নদীয়ার ধুবুলিয়া ক্যাম্পে আমার জন্ম ১৯৬০ সালের ২৩ নভেম্বর। ওই ক্যাম্পে থেকে আধপেটা খেয়ে বাড়ি-বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে মা আমাকে মানুষ করেন।

প্রশ্ন: পড়াশোনা কি সেখানেই?

উত্তর: ’৭৬ সালে ধুবুলিয়া দেশবন্ধু উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (নবম-একাদশ) উত্তীর্ণ হই। কৃষ্ণনগর গর্ভমেন্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু অভাবের কারণে মাঝপথে পড়াশোনা ছাড়তে হল।

প্রশ্ন: এই অবস্থায় শিল্পচর্চা সম্ভব? শুধু তো লড়াই!

উত্তর: প্রথাগত শিল্পের কোনও শিক্ষা ছিল না। তবুও শিল্পচর্চাই আমার অন্যতম পেশা। তবে প্রস্তুতি পর্ব একদম ছিল না, এটা বলা যায় না। সে সবই কিন্তু দেখে শেখা। মা-দিদিমা ছাড়া আপনজন কাউকে ছোটবেলায় সেভাবে কাছে পাইনি। তবে শরণার্থী শিবিরের সবাই আমাকে ভালবাসতেন। ওখানে দুর্গাপুজো হত। ক্লাবে এক মৃৎশিল্পী প্রতিমা বানাতে আসতেন। আমি বিভোর হয়ে প্রতিমা তৈরি দেখতাম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একবার হল কী, ওই মৃৎশিল্পীর কাজ দেখে আমিও একটি দুর্গাপ্রতিমা বানিয়ে ফেললাম। তাঁর ফেলে দেওয়া রং আর সাজসজ্জার টুকরো দিয়ে প্রতিমার অঙ্গসজ্জা করেছিলাম। শিবিরের সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ক্লাবের সদস্যরা মূল প্রতিমার সঙ্গে আমার তৈরি প্রতিমাটিও মণ্ডপে রেখেছিলেন।

প্রশ্ন: শিল্পের প্রতি ভাললাগা শুরু হল তখন থেকেই?

উত্তর: সেই প্রতিমা গড়ার ফলে ধুবুলিয়ায় সবাই ‘ঝোটন’কে (আমার ডাক নাম) চিনল। এখনও ধুবুলিয়ায় সবাই আমাকে ওই নামে চেনেন। ধুবুলিয়ায় থাকার সময়ে কৃষ্ণনগরের ঘুরণিতে গিয়ে মৃৎশিল্পীদের কাজ দেখতাম। নিজেকে একলব্যের মতো মনে হয়। আসলে আমার জীবনে অনেক দ্রোণাচার্য! অন্যের কাজ করা দেখে শিখেছি।

প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামে আসা কী ভাবে?

উত্তর: পরিচারিকার কাজ করে আমাকে কলেজে পড়ানো মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যে ভাবেই হোক রোজগার করতে হবে। সম্পর্কিত এক মামার বাড়ি ছিল ঝাড়গ্রামে। ১৯৮০ সালে ঝাড়গ্রামে চলে এলাম। একটি কারখানায় দৈনিক পাঁচ টাকা মজুরিতে শ্রমিকের কাজ শুরু হল। আমার হাতের কাজ ভাল জেনে গিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তাই কঠিন কাজ করতে হত। কারখানার ৭০ ফুট উঁচু চিমনির উপর উঠে রং করেছি। চিমনিতে সংস্থার নাম বিবর্ণ হয়ে গেলে আমাকে লিখতে হত। ততদিনে আলাপ হয়ে গিয়েছিল সঞ্জুদার সঙ্গে। উনি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কী, আর্ট অ্যাকাডমির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে শিল্পের নানা ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। নিজের মতো করে কাজ করার চেষ্টা করে গিয়েছি।

প্রশ্ন: এখানে এসে কাজ শিখলেন?

উত্তর: সারা দিন হাড়ভাঙা শ্রমিকের কাজ। আর সুযোগ পেলেই আর্ট অ্যাকাডেমিতে এসে শিল্পচর্চা। প্রথমে মাটির মূর্তি, তারপর শুরু করলাম সিমেন্টের মূর্তি বানাতে। এখন ফাইবাবের মূর্তি বানাই। আর্ট অ্যাকাডেমির সমস্ত কাজের সঙ্গে আমি ও আমার সন্তানেরা এখন যুক্ত। তবে আমি বাড়িতে স্বাধীনভাবে কাজ করি। বহু ভাস্কর্য তৈরির অর্ডার আসে।

প্রশ্ন: মণ্ডপ শিল্পী হিসেবেও তো পরিচিত আছে আপনার?

উত্তর: বছর কুড়ি আগে মনে হল, নিজে মণ্ডপ বানালে কেমন হয়। ভাবনাটা বাস্তবায়িত হতে কয়েকটা বছর লাগল। নিজের ভাবনায় মণ্ডপ সজ্জার কাজ ধরত শুরু করলাম। বছর আঠারো আগে ঝাড়গ্রামের এক দুর্গাপুজোর প্রতিমা তৈরি করেছিলাম বাঁশ দিয়ে। মণ্ডপের অঙ্গসজ্জাতেও বাঁশের ব্যবহার করেছিলাম। দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে মাওবাদী অশান্তিপর্বের সময়ে সেভাবে কাজ করতে পারিনি। গত কয়েক বছরে আমার তৈরি প্রজাপতির আদলে মণ্ডপ, রাসমঞ্চের আদলে মণ্ডপগুলো খুবই প্রংশসা পেয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার কাজ নিয়ে কিছু বলুন?

উত্তর: সারা জীবনে কত ভাস্কর্য বানিয়েছি সেই সংখ্যাটা আর মনে রাখতে পারি না। আমার ভাস্কর্যের মধ্যে দেবদেবীর বিগ্রহও রয়েছে। তবে আমি কোনও দিন এসব বানানোর জন্য প্রথাগত শিক্ষা নিইনি। তবে একজনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি হলেন ঝাড়গ্রাম আর্ট অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ সঞ্জুদা (সঞ্জীব মিত্র)। তিনিই আমার মধ্যে শিল্প চেতনার সলতেটাকে উস্কে দিয়েছেন।

প্রশ্ন: আর কী কী কাজ রয়েছে?

উত্তর: এক সময় প্রচুর তৈলচিত্র আর জল রঙে ছবি এঁকেছি। এখন মূলত সিমেন্ট, মাটি, ফাইবার দিয়ে মূর্তি ও স্থাপত্য এবং বিভিন্ন শিল্প সৃষ্টি করি। এ ছাড়া দুর্গাপুজোর থিমের মণ্ডপ কিংবা অন্যধারার মণ্ডপ তৈরি করি। দুর্গা প্রতিমাও বানাই। ভাল লাগে যখন দেখি আমার মণ্ডপ বা প্রতিমার অনুকরণে পরের বছর অন্য জেলায় কোনও শিল্পী কাজ করছেন। ভাবনাটা যে ঠিকঠাক ছিল, সেটা বুঝতে পারি।

প্রশ্ন: আরেক রকম শিল্পকর্মের জন্যও লোকে আপনাকে চেনেন?

উত্তর: হ্যাঁ, দেওয়ালের শিল্পকর্ম, ফ্রেস্কো। ঝাড়গ্রামে নিজের বাড়ির দেওয়ালে এই শিল্পের নমুনা রয়েছে। ঝাড়গ্রামের সরকারি ও বেসরকারি অনেক জায়গায় আমার কাজ আছে।

প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামে বহু কাজ আপনার?

উত্তর: আমার তৈরি ভাস্কর্য ঝাড়গ্রামের সরকারি আদিবাসী সংগ্রহশালা চত্বরের শোভা বাড়িয়েছে। ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে আমার তৈরি ভাস্কর্য রয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহরের উপকন্ঠে বাঁদরভোলায় পর্যটন দফতরের আদিবাসী সংগ্রহশালা চত্বরে সিমেন্টের তৈরি প্রমাণ মাপের নৃত্যরত আদিবাসী চার মহিলা এবং হাতির মূর্তিগুলো আমার বানানো। গোপীবল্লভপুরের ছাতিনাশোল মোড়ে পূর্ত দফতর স্বামীজির একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি বসিয়েছে। ফাইবাবের ওই মূর্তিটি আমার বানানো। ঝিল্লি পাখিরালয় ও গোপীবল্লভপুর ভেষজ উদ্যানের তোরণের অঙ্গসজ্জার কাজও আমার ভাবনায় হয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহরের উপকন্ঠে ক্রিস গার্ডেনের বেশির ভাগ ভাস্কর্য আমার তৈরি।

প্রশ্ন: জেলার বাইরে কাজ করেছেন?

উত্তর: বীরভূমের তারাপীঠের কাছে চিতুড়ির একটি মন্দিরে আমার তৈরি সিমেন্টের কালীর বিগ্রহ রয়েছে। এলাকাটি এখন তীর্থক্ষেত্র।

প্রশ্ন: প্রিয় শিল্পী কে?

উত্তর: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ ভট্টাচার্য। ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধানের কাজ দেখে শ্রদ্ধা-আবেগ চেপে রাখতে পারি না। এখন গৌরাঙ্গ কুইল্যা খুব ভাল কাজ করছেন। যদিও মণ্ডপ শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, তবুও গৌরাঙ্গের কাজ খুবই ইনোভেটিভ। আমি রোজই কিছু না কিছু শিখছি।

প্রশ্ন: ভাললাগার জায়গা?

উত্তর: বাড়িতে আমার স্টুডিয়োতে স্বাধীন ভাবে কাজ করি। খুব কষ্ট করে আজকের জায়গায় পৌঁছেছি। ঊনষাট বছরের জীবনে যেমন অনেক কিছু হারিয়েছি, তেমনই মানুষের ভালবাসাও পেয়েছি অনেক। খুব ভাল লাগে, যখন প্রশাসনের কর্তারা ডেকে সরকারি সৌন্দর্যায়নের জন্য পরামর্শ চান, কাজের বরাত দেন। স্ত্রী ঝরনা কাজে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। আমার ছেলে মেয়ে চিত্রলেখা ও ঋতাশিস। ছেলে আমাকে শিল্পকর্মে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: ধুবুলিয়ার কথা মনে পড়ে?

উত্তর: প্রথমে ঝাড়গ্রামে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। এখন কদমকাননে নিজের বাড়ি করেছি। প্রতি বছর এখনও নিজের জন্মস্থানে যাই। জানেন আমার আরেকটা পেশা আছে। আগে নিজে ছিলাম শ্রমিক। এখন ওই কারখানায় শ্রমিক সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছি।

প্রশ্ন: আপনার কাজে প্রকৃতির প্রভাব দেখা যায় খুব বেশি।

উত্তর: দীর্ঘদিন অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রামে থাকার সুবাদে আমার সমস্ত কাজের মধ্যে প্রকৃতির প্রতিফলন রয়েছে।

প্রশ্ন: কী রকম সেই প্রতিফলন?

উত্তর: এখানকার শালগাছের জঙ্গল, প্রকৃতি আমাকে টানে। আমার কাজে বারে বারে তাই প্রকৃতি ঘুরে ফিরে আসে। সে বোধিবৃক্ষের তলায় গৌতমবুদ্ধ হোক কিংবা আদিবাসী দম্পতির মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে জঙ্গলপথে বাড়ি ফেরার মতো বিষয়ের ‘রিলিফওয়ার্ক’গুলো আমার ভাল লাগে। এই শিল্পকর্ম বেশি করে কিনতে চান শিল্পরসিকরা। এখন যেভাবে ঝাড়গ্রাম শহর ও লাগোয়া এলাকায় সবুজ ধ্বংস হচ্ছে, তাতে কষ্ট হয়। ঝাড়গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে আদিবাসী-মূলবাসী মানুষের জীবনজীবিকা জড়িয়ে রয়েছে। এখনও শহরের কিছু মানুষ জঙ্গলের সম্পদ সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন। এভাব গাছ কেটে জীবন ও জীবিকার ক্ষতি করা হচ্ছে। ফাইবার দিয়ে একটি ‘রিলিফ’ তৈরি করেছি। নাম দিয়েছি ‘জঙ্গল ও জীবন-জীবিকা’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Alok Mishra Artist Jhargram
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE