প্রশ্ন: এক সময়ে তো মহিষাদল ছেড়েছিলেন?
উত্তর: হ্যাঁ। আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে এলাম আমরা। বরানগর বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তবে মহিষাদলের সঙ্গে যোগসূত্র ছেঁড়েনি। ছোটবেলায় হামেশাই মহিষাদলে আসতাম। সেই সময় গ্রামের বাড়িতে খেলা হত। খুব মজার আর আদরের ছিল আমাদের শৈশব। গরমের ছুটি বা বড়দিনের মতো লম্বা ছুটিতে যেতাম গ্রামের বাড়ি। তাই গ্রামের মাটির সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। আজও সময় পেলেই চলে যাই মহিষাদলে। অনেক সময় গ্রামে এলে চাঙ্গা হয়ে যাই। মহিষাদলে ফিরলে আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তার পর রিফ্রেশ হয়ে ফিরে যাই কলকাতায়।
প্রশ্ন: ছোটবেলায় ফুটবলের পাঠ কী ভাবে নিলেন?
উত্তর: বরানগরে যুগ জাগরণ নামে একটা ক্লাব ছিল। সেই ক্লাবে একেবারে ছোটবেলায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমার দাদাও খেলত একই ক্লাবে। দুই ভাই এক সঙ্গেই খেলতে যেতাম। দাদা শোভন চক্রবর্তী আমার চেয়ে বড় খেলোয়াড় ছিল। দাদার কারণেই সবাই আমাকে চিনত। দাদার জন্যই ফুটবলে আগ্রহ বাড়ে। দাদা সেই সময় সাইয়ে সুযোগ পান। ওকে দেখেই ফুটবলে সিরিয়াস অনুশীলন করি। বাবা ও মা খেলার বিষয়ে অনেকটাই ছাড় দিয়েছিলেন। স্কুল ফুটবল খেলার সময় একটু নাম হয়। অনেকেই সেই সময় বলতে থাকেন, ফুটবলটা ভালই খেলি। একটু চেষ্টা করলে সাফল্য আসবে। তাই নাছোড় হয়ে লেগেই রইলাম ফুটবলে।
প্রশ্ন: আপনি টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির ছাত্র। সেখানে কী ভাবে সুযোগ পেলেন যদি বলেন?
উত্তর: টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি সেই সময় সারা দেশ থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করার কাজ করছে। সেই সময় টিএফএ-র কোচ ছিলেন পি কে স্যার, হাবিব স্যার। তাঁদের কাছে ফুটবলে পাঠ নেওয়া একটা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। ট্রায়ালের খবর পাওয়ার পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ১৯৯২ সালেই জামশেদপুরে ট্রায়ালে গিয়েছিলাম। ট্রায়ালে নির্বাচিত হয়ে যাই। আবাসিক ক্যাম্প ছিল। দারুণ অভিজ্ঞতা। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল টিএফএ-তে সুযোগ পাওয়া। চার বছর ধরে শিখলাম, এই দুই সেরা কোচের কাছ থেকে। সেই সময় বেশ কিছু বিদেশ সফর হয়েছিল। আমরা বেশ কিছু সফরে গিয়েছিলাম। টিএফএ-র সেই দিনগুলোই আমাদের তৈরি করে দিল দেশের সেরা ক্লাবে খেলার জন্য। সেখান থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম, সবুজ মেরুন জার্সি গায়ে ডার্বি ম্যাচ খেলছি।
প্রশ্ন: টিএফএ-তে আপনার সঙ্গে কারা ছিলেন?
উত্তর: আমার সঙ্গে রেনেডি সিংহ, দীপেন্দু বিশ্বাস, কল্যাণ চৌবেরা ছিল। আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট।
প্রশ্ন: আপনি দেশের অধিনায়কও হয়েছিলেন। সেই সময়কার কথা একটু বলুন।
উত্তর: ১৯৯৫ সালে আমি অনূর্ধ্ব ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছি। তাঁর আগে আমি অনূর্ধ্ব ১৬ দলের অধিনায়ক ছিলাম। ১৯৯৬ সালে আমি এশিয়া কাপ দলে সুযোগ পাই। পরের বছর আমি মোহনবাগানে যোগদান করি। মোহনবাগানে এক বছর খেলি। ১৯৯৭ সালে আমি ইস্টবেঙ্গলে খেলি। সেখানেই আমার জীবনের মোড় আরেকবার ঘুরে যায়। মর্মান্তিক পরিণতি হয় আমার।
প্রশ্ন: সে তো ভয়ানক মোড়!
উত্তর: লিগের খেলার সময় চিমার সঙ্গে ট্যাকলে পা ভেঙে যায়। এই আঘাতের পরে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় খেলা। সেই সময় ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা অনেকে চেষ্টা করেছিলেন আমাকে মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। সে আর হয়ে ওঠেনি। মাঝে সুদীপ ভট্টাচার্য কোচ হয়ে আসেন। নানা কসরত করে ফিট হয়ে মাঠে নামি। কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন নন। তাই ১৯৯৮ সালে আবার চোট লাগে। আইটিআই-এর বিরুদ্ধে চোট লাগে। মাঠ ছাড়ি স্ট্রেচারে। তার পর মাঠে ফেরার চেষ্টা করলেও চোট আঘাত আমার পায়ের শক্তি কমিয়ে দিয়েছিল। একদিন বিদায় জানালাম ফুটবলকে। তখন আমার বয়স মাত্র ২৪ বছর। চোখের জলে সেই বিদায়। খুব কষ্টের ছিল সেই দিন। সেই সময় কোনও খেলা দেখতাম না। খেলার খবর রাখতাম না। খবরের কাগজও পড়তাম না।
প্রশ্ন: ফিরে আসার চেষ্টা চলেছিল তো? কেমন ছিল সেই লড়াই?
উত্তর: সেই সময় সাইয়ের চিকিৎসক মানবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অনুপ অধিকারী, লায়লা দাসেরা অপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। আমিও ঝাঁপাই। কিন্তু আমার পায়ের জোর কমে গিয়েছিল। সন্তোষ ট্রফি, ডুরান্ড, আইএফএ লিগ খেলা লোকটা হেরে গেল। বিদায় জানাল ফুটবলকে।
প্রশ্ন: কিন্তু ফিরে আসতে পেরেছেন মাঠে। কী ভাবে সম্ভব হল সেটা?
উত্তর: ফুটবল মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তখন কাঠ বেকার। খুবই হতাশ। সেই সময় ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী কলকাতা পরিবহণ দফতরে কাজ দিলেন। ব্যাস শুরু হল চাকরি। সেই সময় আমি ফুটবল থেকে বহু দূরে। কোনও খোঁজ খবর রাখতাম না। সেই পরিবহণ দফতরে আজও চাকরি করি। তবে গত বছর পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী আমাকে স্পোর্টস অফিসার করেছেন।