Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পরকীয়া এক জটিল প্রশ্ন

শাস্ত্রমতে, পরকীয়া (অ্যাডালটরি) হল ‘স্ত্রীসংগ্রহণ’

শামিম আহমেদ
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

শ্বেতকেতুর মা যখন স্বামীর অনুমতি না নিয়েই অন্য এক জন পুরুষের সহগামিনী হচ্ছেন তখন উদ্দালকপুত্র ভীষণ রেগে গেলেন। পিতা উদ্দালক (জৈবিক পিতা নন) তাঁকে নিবৃত্ত করলেন: ‘‘তুমি রাগ কোরো না পুত্র, এটাই স্ত্রীলোকের চিরাচরিত ধর্ম, সে গাভীর মতো স্বাধীন। এই দেহের অধিকার তার। কাজেই অন্যগমন অন্যায় নয়।’’ শ্বেতকেতু ভুললেন না সে কথায়। তিনি পশুপক্ষীদের মতো প্রাচীন আচার বাতিল করে নারীর একপতিত্বের ফরমান জারি করলেন। মহাভারতে পাণ্ডু কুন্তীকে যখন এই প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব শোনাচ্ছেন, তখন এ কথাও জানাতে ভুলছেন না, নারী স্বাধীন আর এই বিচরণ স্ত্রীলোকের প্রতি প্রকৃতির অনুগ্রহের সূচক।

শাস্ত্রমতে, পরকীয়া (অ্যাডালটরি) হল ‘স্ত্রীসংগ্রহণ’। বিবাহিত স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হলে তা স্ত্রীসংগ্রহণ নামে বিবেচিত হয়। শ্রুতি, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ ও দর্শনে পরকীয়া সম্পর্কে অনেক রকম মত। পরকীয়াকে কোথাও জঘন্য অপরাধ বলা হয়েছে, অন্য দিকে আবার স্ত্রীসংগ্রহণ বিষয়ে নমনীয়তার উদাহরণও অনেক।

প্রথমে শ্রুতি বা বেদের কথা। ঋগ্বেদে পরকীয়াকে ‘পাপ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে (৪.৫.৫)। তবে সেই পাপ হল নৈতিক। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন যজ্ঞের সময়, এড়িয়ে চলা উচিত বলা হয়েছে অথর্ববেদ ও উপনিষদে। ঋগ্বেদের বহু জায়গায় অবশ্য পরপুরুষের জন্য নারীর হৃদয়ের উৎকণ্ঠার কথা বিবৃত হয়েছে। এমনকি একটি মন্ত্রে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা: গর্ভবতী স্ত্রীলোক যে হেতু স্বামী ও অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তাই তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ সুরক্ষিত থাকে। শ্রুতির দিক থেকে বিচার করলে পরকীয়া নৈতিক পাপ হিসাবে গণ্য।

পরবর্তী কালে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে পরকীয়াকে দু’ভাবে দেখা হয়েছে। মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। পরদারসম্ভোগে প্রবৃত্ত হলে রাজা নাক-কান ছেদন ইত্যাদি এমন দণ্ড দেবেন যা দেখে অন্যরা ভীত হবে, নাক-কান কাটা অবস্থায় তাদের দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে (৮/৩৫২)। আচার্য মনুই আবার জানাচ্ছেন, অন্য পুরুষের দ্বারা উৎপন্ন পুত্র ওই স্ত্রীর স্বামীর সন্তান বলেই পরিগণিত হবে, জৈবিক পিতার নয়। পরস্ত্রীতে উৎপাদিত পুত্ররা ‘কুণ্ড’ ও ‘গোলক’ নামে পরিচিত (৩/১৭৪)।

মনুসংহিতার একাদশ অধ্যায়ে পরকীয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ না বলে প্রায়শ্চিত্তযোগ্য পাপ বলা হচ্ছে। (গুরুপত্নী বা বিমাতা প্রভৃতি) পরস্ত্রীগমনজনিত পাপ ক্ষালনের জন্য হবিষ্য (দুধ, ফল, ঘি ইত্যাদি) এবং যবাগূ (যাউ) আহার করে সংযতেন্দ্রিয় হয়ে, তিন মাস অবধি চান্দ্রায়ণ ব্রতের আচার করার বিধান দেওয়া হয়েছে: চান্দ্রায়ণং বা ত্রীন্ মাসানভ্যস্যেন্নিয়তেন্দ্রিয়ঃ/ হবিষ্যেণ যবাগ্বা বা গুরুতল্পাপনুত্তয়ে।। (১১/১০৭)

মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ে স্ত্রীসংগ্রহণ যেমন গুরুতর অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য, তেমনই ‘আপস্তম্ব ধর্মশাস্ত্র’ নামের স্মৃতিশাস্ত্রে পরকীয়াকে কুকর্ম বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে পুরুষের অধিক শাস্তি ও নারীর কম শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। তবে গৌতমসংহিতায় পুরুষের তুলনায় নারীর বেশি শাস্তির নিদান আছে। মজার কথা, নারদস্মৃতিতে বলা হয়েছে, বিবাহিত নারী ও অন্য পুরুষের এই যৌনতা যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয়, তা হলে তাকে অপরাধ বা অন্যায় বলা যাবে না।

মহাভারতেও পরকীয়া অনিন্দিত নয়। কিন্তু সেখানেই আবার পরদারগমনের বহু নিদর্শন। নররূপী ঋষি অর্জুন যখন ব্রহ্মচর্য ও বনবাসের শাস্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখন তিনি পরস্ত্রী ঊলূপীর সঙ্গে অনেক দিন বসবাস করেন এবং তাঁর গর্ভ থেকেই ‘ইরাবান’ নামক পুত্রের জন্ম। নাগকন্যা ঊলূপীর স্বামী তখন সূপর্ণ নামক নাগের কাছে বন্দি ছিলেন। ইন্দ্র ও অহল্যার কথা সর্বজনবিদিত। তাঁদের দু’জনেরই শাস্তি হয়েছিল। অহল্যাপতি গৌতমের অভিশাপে ইন্দ্র হলেন গলিতাণ্ড আর অহল্যা পাথর। দক্ষের সাতাশ জন কন্যার স্বামী চন্দ্র। তিনি গুরুপত্নী অর্থাৎ দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে বহু দিন কাটান। তারারও সম্মতি ছিল। তাঁদের পুত্রের নাম ‘বুধ’। ব্রহ্মার হস্তক্ষেপে বৃহস্পতি তারাকে ফিরে পান।

সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীন গ্রন্থ ‘কামসূত্র’তেও পরকীয়াকে অপরাধ বলা হয়নি। তবে সেই সব পুরুষের নিন্দা করা হয়েছে যাঁরা প্রেমহীন পরকীয়াতে মত্ত হয়ে ওঠেন। বাৎস্যায়ন, কামসূত্রের রচয়িতা বলছেন, যৌনতার একটি উদ্দেশ্য কখনও-সখনও সন্তান-উৎপাদন হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। স্ত্রীলোক পশুদের থেকে আলাদা, কারণ সে সন্তানধারণের উপযুক্ত সময় ছাড়াও রমণে প্রবৃত্ত হয়। পুরুষের মতো নারীও আনন্দের জন্যই যৌনতা চায়। এমনকি, যদি কোনও স্ত্রীলোক বোঝেন যে তাঁর স্বামী সন্তোষজনক যৌনসঙ্গী নন, তা হলে তিনি সেই যৌনসঙ্গীকে ত্যাগ করতে পারেন। বিধবারাও যৌনতৃপ্তির জন্য সঙ্গী খুঁজতে পারেন। প্রাচীন এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।

নারীর নিজ শরীরের অধিকারের কথা যেমন নানা গ্রন্থে রয়েছে, তেমনই আছে পিতৃতন্ত্রের অমোঘ ফরমান, যেখানে নিহিত থাকে পুত্রসন্তানের জৈবিক পিতা হওয়ার উৎকণ্ঠা, পুরুষের সম্পত্তি যেন অন্য পুরুষের সন্তান এসে ভোগ না করে। নারীও সেখানে সম্পত্তি, তাঁর ভূমিকা প্রাণহীন বস্তুর মতো। তবে শেষ পর্যন্ত পরকীয়া শুধু যে দেহেই সীমাবদ্ধ থাকে, এমন নয়। শরীর থেকে উত্তরণের কথাও পরকীয়াতে পাওয়া যায়। বৈষ্ণব দর্শনে আয়ান-বধূ রাধার সৃষ্টি সচ্চিদানন্দ ভগবানের লীলাসুখ অনুভবের নিমিত্ত। জীব স্বকীয়তা ভুলে পরাধীন। সেই জীব ভগবানের ডাকে সাড়া দিলে তার নাম হয় ‘পরকীয়া অভিসার’।

নৈতিক পাপ ও ফৌজদারি অপরাধ এক নয়। তবু স্বামীর অনুমতি নিলে পরকীয়া বিশুদ্ধ হয়ে যাবে, এমন কথা বলে আইন-প্রণেতারাই অপরাধ করছেন। কোনও ধর্মগ্রন্থ এ কথা বলে না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া পরকীয়া দণ্ডনীয় অপরাধ বলার মধ্য দিয়ে নারীর শরীরে ভোগ্যপণ্যের সিলমোহর দেওয়া হয় মাত্র। পরকীয়ার সাজা শুধু পরপুরুষ পাবে, এমন ভাবনাও নারীর পক্ষে অপমানজনক।

নারীর ব্যক্তিত্বের নানা মাত্রা শাস্ত্রে বিদ্যমান। স্ত্রীলোক সেখানে ভোগ্যপণ্য, এ ধারণা একদেশদর্শী ও বিভ্রান্তিকর। যাঁরা বলছেন, ভারতীয় ভাবাবেগের ক্ষেত্রে পরকীয়া হানিকর, তাঁরা না পড়েছেন ভারতীয় শাস্ত্র, না মানেন প্রাকৃতিক ন্যায়ের বিধান।

(রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির-এ দর্শনের শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mythology Epic Shri Krishna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE