Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শুধু ঋণ মকুবে কাজ হবে না

খাদ্যপণ্যের দামের প্রসঙ্গ উঠলেই নোটবাতিলের কথা শোনা যাচ্ছে। যুক্তিটা এই রকম— নোটবাতিলের ফলে নগদের অভাব হয়েছে, এবং তার ফলেই খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে।

সৌম্যকান্তি ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৭ ১৩:৫৩
Share: Save:

ইদানীং মূল্যস্ফীতির হারের কথা ভাবলেই আমার অনুপম রায়ের সেই গানটার কথা মনে পড়ে— আমাকে আমার মতো থাকতে দাও! অবশ্য, মূল্যস্ফীতির হার কাউকে নিজের মতো বাঁচতে দিয়েছে, এমন অভিযোগ নেই। খাবারের মূল্যবৃদ্ধি গৃহস্থের বাজেটের দফারফা করে ছাড়ে। গত কয়েক মাসে (বস্তুত, কয়েক বছর ধরেই) ছবিটা পাল্টাচ্ছে। পাইকারি এবং খুচরো, দুই ধরনের হিসেবেই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার পড়তির দিকে। ২০০৭ সাল থেকে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির সূচক পাওয়া যায়। সেই সময় থেকে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটছে। কেন খাবারের দাম তেমন বাড়ছে না, বস্তুত কমছে; এবং, দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যপণ্যের দাম এমন কম থাকলে অর্থনীতির ওপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে— এই দুটো প্রশ্ন কিন্তু ভাবার মতো।

খাদ্যপণ্যের দামের প্রসঙ্গ উঠলেই নোটবাতিলের কথা শোনা যাচ্ছে। যুক্তিটা এই রকম— নোটবাতিলের ফলে নগদের অভাব হয়েছে, এবং তার ফলেই খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। অর্থনীতির ওপর নোট-বাতিলের কী প্রভাব পড়েছে, তা বিশেষত অসংগঠিত নির্মাণ শিল্পের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু, কৃষিক্ষেত্রে নোট-বাতিলের সেই প্রভাব পড়েনি। বস্তুত, নগদ টাকায় চলে, এমন ক্ষেত্রগুলির মধ্যে শুধুমাত্র কৃষির ওপরই এই প্রভাব তেমন মারাত্মক হয়নি, কারণ ফসল বোনার সময় নাবার্ড নগদের অভাবের সমস্যার মোকাবিলা করতে সরাসরি মাঠে নেমে পড়েছিল।

আমরা কৃষিপণ্যের মূল্যস্তরের ধাঁধার সমাধান করতে আরও এক কদম হেঁটেছি। ২০১৪ সালের মে মাস থেকে কৃষিপণ্যের মূল্যস্তরের পরিসংখ্যান নিয়ে তার ওপর সাময়িক ও স্থায়ী প্রভাবগুলিকে আলাদা করেছি। ২৫টি রাজ্যের মান্ডিতে কৃষিপণ্যের মূল্যস্তরের ভিত্তিতে এই হিসেব কষা হয়েছে। আমরা তিনটি প্রাথমিক কৃষিপণ্য নিয়ে কাজ করেছি— আলু, পেঁয়াজ আর টমেটো। আমাদের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে আলু আর পেঁয়াজের দাম ২০১৪ সালের মে মাসের তুলনায় কম ছিল। অর্থাৎ, নোট-বাতিলের আগেই দাম পড়়েছে। অক্টোবরের পরেও দাম কমেছে— তার কারণ সম্ভবত আলু-পেঁয়াজের বিপুল উৎপাদন। টমেটোর দাম খানিক বেড়েছে বটে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে কয়েকটা নির্দিষ্ট রাজ্যে।

এই বিশ্লেষণ সত্য হলে বোঝা যাচ্ছে, আলু, পেঁয়াজ ও টমেটোর ক্ষেত্রে বাজারে যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তা আর কৃষকের পক্ষে লাভজনক নয়। দামের এই অসামঞ্জস্য দূর করার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সরকারি হস্তক্ষেপের ফলেই কৃষি-পণ্যের দাম পড়ে যাওয়ার প্রবণতা ঠেকানো গিয়েছে।

মান্ডির মূল্যস্তরের দিকে না তাকালেও খাদ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার প্রবণতাটি আঁচ করা সম্ভব— সার্বিক ভাবে খুচরো মূল্যসূচকের বৃদ্ধির হারের দিকে নজর রাখলেই চলবে। গত তিন বছরের গড় মূল্যস্তরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এখন খাদ্যপণ্যের দাম সেই গড়ের তুলনায় কম। যেমন, ২০১৭-র এপ্রিলে তরিতরকারির মূল্যস্তরের সূচক গত তিন বছরের গড়ের তুলনায় ১৩% কম ছিল।

খাদ্যপণ্যের দাম কমছে কেন? তার একটা বড় কারণ হল, সাম্প্রতিক কালে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ব্যবস্থার কাঠামোয় কিছু সংস্কার হয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে মহারাষ্ট্রে দ্রুত পচনশীল খাদ্যপণ্যের বাজারটিতে সংস্কার হয়েছে। কর্নাটক খাদ্যপণ্যের ডিজিটাল বাজারে সেরার তালিকায় উঠে এসেছে। এই রাজ্যগুলিতে খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুত কমেছে। এ বছর স্বাভাবিক বর্ষার পূর্বাভাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামও পড়তির দিকে। ফলে, এই অর্থবর্ষে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকারই সম্ভাবনা।

খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে কৃষক-বিক্ষোভ চলছে, এ বার সে প্রসঙ্গে আসি। সমস্যা দুটো— এক, ভারতের মতো দেশে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের অভাব; দুই, মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে তোলা। একটা উদাহরণ দিই। ভারতে খাদ্যশস্য এবং অন্য কিছু কিছু শস্যের জন্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেয়, কিন্তু তরিতরকারি এবং ফলের জন্য এমন কোনও ব্যবস্থা নেই, অথচ সেগুলির গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। ঠিক যেমন, রাজস্থানের মতো রাজ্যে, যেখানে জলের অভাব মারাত্মক, সেখানে বিপুল পরিমাণ জল খরচ করে গম উৎপাদন করা হলে তার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা কেন থাকবে, তার কোনও কারণ নেই। মহারাষ্ট্রে আখের উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কথাটি সমান সত্য।

সরকারের কী কর্তব্য? প্রথমত, যাতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের যথেষ্ট পরিকাঠামো তৈরি হয়, সে দিকে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন ফসলের জন্য যথাযথ হিমঘরের ব্যবস্থা করতে হবে। খরচ কমানোর জন্য এই হিমঘরগুলি অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল শক্তিতে, যেমন সৌরবিদ্যুতে, চালানো যায় কি না, তা দেখতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের পরিকাঠামো নেই বলে কৃষক চার-পাঁচ টাকা কিলোগ্রাম দরে যে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, উপভোক্তা সে আলুই কেনেন কুড়ি টাকায়, আর পটেটো চিপস বিক্রি হয় কমপক্ষে ২৫০ টাকা কিলোগ্রাম দরে। টমেটো আর টমেটো কেচাপ-এর দামের ফারাকেও গল্পটা একই রকম। আমাদের দেশে যখন কৃষকরা দাম না পেয়ে রাস্তায় টমেটো ফেলে দেন, তখনও আমরা বিদেশ থেকে টমেটো আমদানি করি।

কৃষকের আয়ের নিশ্চয়তা তৈরি করতে হলে দেখতে হবে যাতে সেখানে কৃষিপণ্যের জন্য ভাল দাম পাওয়া যায়, তেমন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে এবং তাতে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ তেমনই ক্ষেত্র। কাজেই, এই ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে চললেই কৃষকের সমস্যা মিটবে না।

সামনের দু’তিন মাস মূল্যবৃদ্ধির হার ২ শতাংশেরও নীচে থাকতে পারে। কৃষির নতুন গল্প তৈরি করার জন্য এটাই সরকারের পক্ষে শ্রেষ্ঠ সময়।

মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এসবিআই।
মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE