Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
দোষ ছাত্রছাত্রীদের নয়, মান্ধাতা আমলের শিক্ষাব্যবস্থার

সত্য শিখতে হবে, তথ্য নয়

এই বক্তব্যে বইপত্রের সঙ্গে বর্তমানে ইন্টারনেটকে জুড়ে নিন। আপনার হাতের মুঠোয় সমস্ত তথ্য। তার জন্য গুগ্‌ল করলেই চলে। আর কাউকে লাগে না।

রোহন ইসলাম
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৩
Share: Save:

ফোনোগ্রাফ, মোশন পিকচার ক্যামেরা, লাইট বাল্‌বের মতো যুগান্তকারী সব জিনিসের আবিষ্কর্তা টমাস আলভা এডিসনের মতটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি আইনস্টাইন। এডিসন শিক্ষাব্যবস্থায় ‘তথ্য’কে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে এডিসনকে চিঠিতে (মে ১৯২১) আইনস্টাইন লিখলেন, ‘শিক্ষায় তথ্যের প্রশিক্ষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। তার জন্য কারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে কোনও জায়গাতেই বইপত্র খুলে তথ্য জানা যেতে পারে। একটি স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে অজস্র তথ্য জানার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। শিক্ষার প্রকৃত মূল্য সেখানেই— যেখানে সে ব্যক্তিকে পাঠ্যপুস্তক ছাড়িয়ে ভাবতে শেখাবে।’

এই বক্তব্যে বইপত্রের সঙ্গে বর্তমানে ইন্টারনেটকে জুড়ে নিন। আপনার হাতের মুঠোয় সমস্ত তথ্য। তার জন্য গুগ্‌ল করলেই চলে। আর কাউকে লাগে না। তাই তথ্যের দিন গিয়েছে। বর্তমান যুগ বিশ্লেষণের যুগ, ভাবতে শেখার যুগ। আগামী পৃথিবীকে তারাই চালাবে, যারা ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করবে। আইনস্টাইনের সুরেই সেই কবে রবীন্দ্রনাথও বলে গিয়েছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ অথচ এত বছর পরেও আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই তথ্যেরই সেবা করে চলেছে। স্মৃতির অভ্যেসে তথ্য উগরে খাপবন্দি কেরানি-চাষের এই কারখানায় কি অন্য ফসল মিলতে পারে? আমাদের শিক্ষাকর্তারা এর উত্তর খুঁজে চলেছেন ‘মাল্টিপ্‌ল চয়েস’-এ।

আসলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ফলাফল কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ‘ক্লাস না করলে ফেল তো করবেন’-এর মতো সরলীকৃত ব্যাখ্যাকে তোল্লাই দেওয়াটা এ ক্ষেত্রে বিবেচকের কাজও হবে না। এই ব্যর্থতা একটা আদ্যিকালের ব্যবস্থার সম্মিলিত দুর্দশার ফল। তার ‘এক্সপায়ারি ডেট’ কবেই পার হয়েছে। বার বার নতুন রঙের পোঁচ দিয়ে তা আর ঢেকে রাখা যাবে না। কেবল পড়ুয়াদের দিকে দায় ঢেলে দিলে, প্রকৃত সমস্যাকেই আড়াল করা হবে।

কী ঘটেছে? মোট ১ লক্ষ ৪০ হাজারের মধ্যে বি এ-তে ৫৭.৫% এবং বি এসসি-তে ২৯% পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্ন। শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে নতুন সমাধানসূত্রে, ফেল করা পড়ুয়াদের একাংশের এ-বারের মতো হয়তো মুশকিল আসান হল। কিন্তু তাতে কি আসল সমস্যা মিটবে? কারণ, বিষয়টি একমাত্র নতুন নিয়মের ফের বা পড়ুয়াদের ক্লাসমুখী না-হওয়ার মধ্যেই সীমিত নেই। আবার বর্তমান সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একা দুষেও লাভ নেই। এটি একটি বিশালকায় মৃত ব্যবস্থার ফল, যে-ব্যবস্থা কখনওই শিক্ষা-বন্ধু হতে পারেনি।

একে অজস্র অনুমোদিত কলেজের ভারে নুয়ে পড়া। তার উপর মান্ধাতার আমলের, শিক্ষাজগতে বাতিলপ্রায়— ‘অ্যানুয়াল সিস্টেম’। এই দুইয়ের জটিল চাপে সমস্যা অনেক। তার কিছু ব্যবহারিক, অনেকটাই দার্শনিক। এই ব্যবস্থায় পড়ুয়া পার্ট-১ দেবেন। তার পরে চার-পাঁচ মাস পার্ট-২’র ক্লাস করে টেস্টের প্রস্তুতিও শুরু করবেন। হঠাৎই ফল প্রকাশিত হলে তিনি জানতে পারবেন, বিগত পরীক্ষায় তিনি ফেল করেছেন। পড়ুয়াটি এ-বার নতুন ক্লাসের পড়া ফেলে ফের পার্ট-১ পড়া শুরু করবেন! এই গোটা ব্যবস্থায় এমনিতেই বছর নষ্ট না করে এক বার ব্যর্থ হওয়া পড়ুয়ার দ্বিতীয় বার সুযোগ মেলার কোনও উপায় নেই। আবার সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষার সুযোগ থাকে কেবল তৃতীয় বর্ষে গিয়ে। বছর নষ্ট না করিয়ে কি দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় না? স্কুল থেকে কলেজে আসার প্রথম বছরে পড়ুয়া সদ্য টলমল পায়ে হাঁটতে শেখে। এক বার পড়ে গেলেই হাঁটা বন্ধ করিয়ে তাকে বসিয়ে দেওয়াটা কি কাজের কথা?

এ-দিকে, কলেজের শিক্ষকদের হাতে এই ডিগ্রি কোর্সের কোনও নম্বর নেই। পড়ুয়াদের ক্লাস করার দায়বদ্ধতা নেই। শিক্ষকদের ক্লাস মন দিয়ে শোনারও। টিউটোরিয়াল এড়িয়ে গেলেও কিচ্ছু আসে যায় না। যেটুকু ক্লাসে আসা, তা বাধ্যতামূলক উপস্থিতির চাপে (একটা বড় অংশের কলেজ
ছাত্র-অসন্তোষের ভয়ে এ-নিয়ে খুব একটা কড়াকড়ি করে না) আর নোটস-সাজেশন নিতে। তারা বুঝে গিয়েছে, এই ব্যবস্থায় সব পড়ার দরকার নেই। দরকার নেই কিছু বোঝারও। জানতেও চায় না, তুমি কী ভাবছ। কে কতটা উগরে আসতে পারছে, তার উপরেই ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে। আবার পরীক্ষায় বছর বছর ঘুরেফিরে প্রশ্নও তো সেই এক। না কর্তৃপক্ষ, না শিক্ষক, না পড়ুয়া— নিজের ‘কমফর্ট জোন’ থেকে কাউকেই বেরোতে না দেওয়ার পথটাকে এ-ভাবেই মজবুত করে রাখে এই ব্যবস্থা।

কিছু ব্যতিক্রম আছেই। তার বাইরে এই গোটা ব্যবস্থা, ‘দূর শিক্ষায় সরকার পোষিত কোচিং সেন্টার’ বই আর কিছু নয়। যার মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শতাধিক কলেজ নামক শাখা-প্রশাখা। যাদের অনেকরই পরিকাঠামো আশপাশের হাই স্কুলের থেকেও অধম। শিক্ষণ, গবেষণা এবং ফ্যাকাল্টি উন্নয়নের বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে, এই ব্যবস্থায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল প্রশাসক ও পরীক্ষা-নিয়ামকের ক্ষুদ্র গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। পরিণত হয় একটি কেন্দ্রীভূত এবং বিফল কাঠামোয়। যা কোনও দিনই সৃষ্টিশীল শিক্ষণ ও পাঠ্যক্রমের মানোন্নয়নকে জমিই ছাড়ে না। এই অসুখ রবীন্দ্রনাথেরও নজর এড়িয়ে যায়নি। এই দুর্ভাগা দেশকে বেচারা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘শিক্ষার সকলের চেয়ে বড়ো অঙ্গটা—বুঝাইয়া দেওয়া নহে, মনের মধ্যে ঘা দেওয়া। ...যাহারা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করিয়া কেবল পরীক্ষার দ্বারাই সকল ফল নির্ণয় করিতে চান, তাহারা এই জিনিসটার কোনো খবর রাখেন না।’

এ-ছবি কেবল কলকাতারই নয়। বর্ধমান বা বারাসতেরও। আবার হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৯০১টি, পুণে বিশ্ববিদ্যালয় ৮১১টি অনুমোদিত কলেজের ভার নিয়ে প্রায় একই ভাবে চলছে। তবে, বহু দিন আগেই তারা সিমেস্টার সিস্টেম চালু করে অনেকটা সমস্যামুক্ত হতে পেরেছে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী? দ্রুত কোনও পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে, কিছু সংস্কার করে বর্তমান ব্যবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলিকে মুক্তি দিয়ে রাজ্য সরকার একটা সদর্থক বার্তা দিতেই পারে। যতটা সম্ভব অনুমোদিত কলেজ থেকে ভারমুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অবিলম্বে একাধিক অঞ্চলভিত্তিক ভাগে ভাগ করে দেওয়া। দরকারে জেলাভিত্তিক (এখনও মুর্শিদাবাদের মতো বড় জেলায় রাজ্যের একটিও বিশ্ববিদ্যালয় নেই)। পুরনো কলেজগুলিকে এ-বার স্বশাসনের দিকে এগিয়ে দেওয়া। অবিলম্বে সিমেস্টার সিস্টেম চালু করা। তিন বছর অন্তর সিলেবাস এবং প্রশ্নের ধরন পালটে দেওয়া। স্কুল-স্তরে মাল্টিপ্‌ল চয়েসের চাষ বন্ধ করা। তথ্যের, স্মৃতির পরীক্ষার বদলে পড়ুয়ারা যাতে চিন্তা করতে পারেন, বিশ্লেষণ করতে পারেন, মৌলিক লেখা লিখতে পারেন— সব মিলিয়ে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সিমেস্টার ব্যবস্থা হচ্ছে, সে-দিকে যাওয়ার প্রথম ধাপ।

সাম্প্রতিক ‘বিল্ডিং ইউনিভার্সিটিস দ্যাট ম্যাটার’ গ্রন্থে শিক্ষাবিদ পঙ্কজ চন্দ্র আক্ষেপ করেছেন, ইউজিসি, এআইসিটিই-র মতো স্বাধীন নীতিনির্ধারক সংস্থারা মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের পুতুল হয়ে উঠেছে। অথচ দরকার ছিল উচ্চ শিক্ষার নীতিনির্ধারক একটি স্বাধীন থিংক ট্যাংক। এমনিতেই মোদীর সরকার উচ্চ শিক্ষা নিয়ে পর পর যে-সব নীতি নিয়ে চলেছে, তার একটাই নির্যাস: পড়ুয়াদের ভাবার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দাও। প্রশ্ন করার পথ বন্ধ করে দাও। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন আস্ত একটি বই (‘এগজাম ওয়ারিয়র’) লিখে ফেলেন, যা পড়ুয়াদের জ্ঞান অর্জন করার বদলে পরীক্ষা ‘ক্র্যাক’ করার ২৫ দফা ‘মন্ত্র’ বাতলে দেয়, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে মস্ত ঘা প্রয়োজন, আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রবল জনসমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসা মা-মাটি-মানুষের সরকারের কাছে সেই ঘা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

education system Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE