বাঙালি উৎসবমুখর। ভোজনরসিকও বটে। তাই আমাদের উৎসবগুলিতে উপবাসের থেকে প্রসাদের গুরুত্ব অনেকটাই বেশি। খাওয়া-দাওয়ার কথাই যদি বলতে হয় তা হলে বাঙালির দুই ঘরোয়া উৎসবের কথাই আগে মনে আসে, জামাইষষ্ঠী আর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। ঘরোয়া, কারণ দোল-দুর্গোৎসবের মতো বাইরের লোক এখানে নৈব নৈব চ।
ভাইফোঁটার কথাই যদি ধরি, খাওয়াদাওয়ার পদতালিকায় বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তনের ছোঁওয়া লেগেছে, প্রবেশ করেছে নতুন ভিনদেশি সব পদ। অবশ্য কিছু চিরন্তনী পদ বাঙালির পাতে কালজয়ী, যেমন ফুলকো লুচি। কচুরি, ডালপুরি, রাধাবল্লভী বা বিলিতি স্যান্ডউইচ, প্রতিযোগিতায় সুবিধে করতে পারেনি কেউই। গোল গোল সাদা সাদা হাওয়াভরা লুচি আমাদের খুব প্রয়োজন। ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লুচি-তরকারি প্রবন্ধে বলেছেন যে ‘‘লুচি যখন পাত্রমধ্যে বিরাজ করে, তখন তরকারিবিহীন হইয়া শোভামান হয় না।’’ খাঁটি কথা! লুচির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে ভাজা-ছোকা-ছেঁচকি-দম-ডালনা-ছোলার ডাল, এমনকি মাছ মাংসও। ‘‘তপ্ত তপ্ত তপসে মাছ গরম গরম লুচি/অজ-মাংস বাঁধাকপি আলু কুচি কুচি।’’ তবে ভাইফোঁটায় লুচি সকালের জলখাবারের পাতেই চলে। তাই সেখানে নিরামিষের দিকেই পাল্লা ভারী। সকালে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল, কুমড়ো-আলু-পটল-ছোলা দিয়ে ছোকা, বেগুন-পটল ভাজা এগুলোই আগে বেশি দেখা যেত। সাদামাটা মেনুতে লুচির সঙ্গে ভাজাভুজি আর আলুর ছেঁচকি বা সাদা আলুর চচ্চড়ি। দু’ক্ষেত্রেই যোগ্য সঙ্গতে উপস্থিত থাকে মিষ্টির থালা।
জলখাবারের এই ‘সামান্য’ গৌরচন্দ্রিকার পর মধ্যাহ্নে আসে মূল পর্ব। ঈশ্বর গুপ্ত উনিশ শতকে বলেছিলেন ‘‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল’’। কিন্তু উৎসবের মেনুতে কি আর শুধু মাছে ভাতে চলে! চাই পোলাও, কালিয়া, চাই মাছ মাংস; চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য সব চাই। উৎসবের পাতে পোলাও-কালিয়া খাওয়ার চল ঠিক কবে থেকে শুরু হল বলা কঠিন। তবে ভারতচন্দ্রের আগে পর্যন্ত সাদা ভাতই বাঙালির পাতে মূলত দেখা গিয়েছে। অন্নদামঙ্গলে অন্নমাংস, কালিয়া, মাংসের শিকভাজা প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। উনিশ শতকে ঈশ্বর গুপ্তের রচনায় পোলাও/পলান্নের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ভাইফোঁটায় ভাইয়ের পাতে সাধারণত মাছ-মাংস ছাড়া নিরামিষ কাজু-কিশমিশ পোলাওই বেশি জনপ্রিয়। পোলাও-এরই আর একটু সরল রূপ ঘি-ভাত। অনেক সময়ে প্রথম পাতে ঘি দেওয়া সাদা ভাতের সঙ্গে ভাজাভুজি, মাছের মাথা দিয়ে ভাজা মুগের ডাল, মাছের চপ অথবা মাছের পুর ভরা পটলের দোলমা দিয়ে খাওয়া শুরুর পর একে একে পোলাও, চিংড়ির মালাইকারি, মাংসের কালিয়া, এই সব প্রধান অতিথিপদ। কিছু বিশেষ পদেরও কথাও বলা যায়। যেমন, মাছের হরগৌরী বা গঙ্গা-যমুনা। তবে উৎসবের পাতে পোলাও-কালিয়ার প্রতি আসক্তির পাশে মোগলাই ঘরানার বিরিয়ানি, চাঁপ, এদের কিন্তু উনিশ বা বিশ শতকেও ভাইফোঁটার পাতে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন রূপে চিনা আগ্রাসনও।
এ বার আসি শেষ পাতের গল্পে, মধুরেণ সমাপয়েৎ। গোপাল হালদার যথার্থই বলেছেন বাঙালি সংস্কৃতি হল রসগোল্লা আর সন্দেশের সংস্কৃতি। যদিও এই দু’টির কোনওটিই মঙ্গলকাব্য বা বৈষ্ণব সাহিত্যের যুগে বাঙালির পাতে পাওয়া যায়নি। তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিশেষ দিনে বিশেষ পাতে এর চল শুরু হয়। কিন্তু বাঙালির পাতে এর প্রবেশ আর একটু পরে, উনিশ শতকের শেষের দিকে। এক সময়ে গুপ্তিপাড়ার সন্দেশের চাহিদা ছিল খুব। সকালের জলখাবারে লুচির সঙ্গে সাধারণত কড়া পাকের সন্দেশের সঙ্গতই ছিল বেশি। কড়া পাকের মধ্যে বাতাবি, আতা, তালশাঁস প্রভৃতির নাম উল্লেখ্য। নরম পাকের মধ্যে গোলাপি পেড়া, শাঁখ সন্দেশ ভাইফোঁটায় বেশ জনপ্রিয়। পেস্তা-বাদাম দেওয়া বাদশাহি চেহারার দিলখুশ বা জাফরানি সন্দেশ, প্যারাডাইস, রোজ় ক্রিম, আবার খাব, বাদশাভোগ এই সব। বিশ শতক থেকে ভাইফোঁটা ছাপ দেওয়া সন্দেশের চল ওঠে। এখনও এই ট্র্যাডিশন বজায় আছে। আজকাল আবার চকোলেট সন্দেশের উপরও ভাইফোঁটার ছাপ দেখা যাচ্ছে। ভাইবোনের ছবি লাগিয়ে কেকের চলও শুরু হয়েছে। রসের মিষ্টির মধ্যে আটপৌরে রসগোল্লার পার্বণী সংস্করণ রাজভোগ ও কমলাভোগই এখনও বেশি দেখা যায় ভাইফোঁটার পাতে। কেনা মিষ্টির পাশাপাশি ঘরের হেঁশেলের চালের পায়েসকেও ভুললে চলবে না মোটেই। এই সব পড়তে পড়তে ভাবছেন নিশ্চয় এত গুরুপাক খাবার— হজম হবে তো? হজম তো হতেই হবে! রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘‘শোভন হাতের সন্দেশ পান্তোয়া,/ মাছমাংসের পোলাও ইত্যাদিও/ যবে দেখা দেয় সেবামাধুর্যে-ছোঁওয়া/ তখন সে হয় কী অনির্বচনীয়’’।
সুন্দরবন মহাবিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy