ক্রন্দনরত অর্ধেক আকাশে ভোরের সুবাতাস দিকে দিকে ছড়িয়ে দিল শান্তির হিমধারা। পশুচিকিৎসক তরুণীর দগ্ধদেহ থেকে তখনও যেন ধিকিধিকি জ্বলছে পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও ক্ষোভের আগুন। সময় ভোর তিনটে, তেলঙ্গানা পুলিশের বিশাল কনভয় তরুণীকে ধর্ষণ করে ও পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অভিযুক্তদের নিয়ে উপস্থিত হল অকুস্থলে ঘটনার পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে। অভিযোগ, ওই সময়ে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে পুলিশের উপরে গুলি ছুড়ে পালানোর চেষ্টা করে অভিযুক্তরা। আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে পুলিশের পাল্টা এনকাউন্টারে নিহত হয় অভিযুক্ত চার খুনি-ধর্ষক।
ওই রাতে শামশাবাদের টোল প্লাজায় পুলিশি নিরাপত্তার ঢিলেঢালা ও ঔদাসীন্যের চিত্রটা যখন প্রতীয়মান হয়েছিল, তখন তা জনমানসে পুলিশের প্রতি বিস্তর ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। সেই ক্ষোভও মুহূর্তে বদলে গিয়েছে আনন্দে। যা পুলিশকে রাখি পরানো থেকে শুরু করে পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বর্ষিত হয়েছে মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছাস ও আবেগে। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশের গুলি চালানোর অধিকার একেবারেই আইনসিদ্ধ। সুতরাং, যাঁরা এনকাউন্টার আইনবিরুদ্ধ বলে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁদের যুক্তি এখানে খাটে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, মাত্র চার জন নিরস্ত্র যুবক কী করে পুলিশের বিশাল বাহিনীর কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের উপর পনেরো রাউন্ড গুলি চালাতে পারে? এটাকে কি পুলিশের সাফল্য বলা চলে? না কি একরাশ ব্যর্থতার চিত্র বহন করে? আর একটি বড় প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই মনে আসছে— যদি এটি প্রকৃত এনকাউন্টার না হয়ে এনকাউন্টারের নাটক সাজিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন হয়, তা হলে সেটি হবে ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত বিচারব্যবস্থার উপর চরম অনাস্থার নিদর্শন। তদন্ত প্রক্রিয়া এগোল না, চার্জশিট পেশ হল না, শুনানির পর্যায়ক্রম বা রায়দান ব্যতিরেকে অর্থাৎ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে ড্রেসিংরুমে বসিয়ে রেখে রেফারিহীন খেলায় সমস্ত নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে পুলিশ কি করে ‘সাজা’ নামক ‘গোল’টির (‘গোল’ অর্থ এখানে ‘মিশন’) স্কোরার হয়ে উঠতে পারে?
যদিও আইন ও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত লয়ে অতি শ্লথতার সঙ্গে চলতে থাকে, শুধু শুনানির ‘তারিখ পে তারিখ’ এ ভাবেই এগিয়ে যায় বছরের পর বছর, বিচারপ্রত্যাশী নিগৃহীতার পরিবার পায় না সঠিক বিচার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আবার আইনের যাঁতাকলে পড়ে ছাড়া পেয়ে যায় কেউ কেউ। যেমনটি হয়েছিল নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডে মাত্র কয়েক মাসের জন্য নাবালক প্রতিপন্ন হওয়া সব চেয়ে নৃশংস খুনি ধর্ষকটির ক্ষেত্রে। জনগণের ক্ষোভের আঁচ থেকে বাঁচাতে তার নাম-পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। বাকি অভিযুক্তদের মধ্যে এক জন আত্মহত্যা করেছে, অন্যদের চরমসাজা এখনও হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন মহলে দাবি উঠতে শুরু করেছে যে, এই ধরনের ঘৃণ্যতম নারকীয় অপরাধের ক্ষেত্রে চটজলদি কঠোরতম সাজা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন নতুন আইন প্রণয়ন।
যেখানে সারা দেশে প্রতি পনেরো মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিতা হন, সেখানে কত জন ধর্ষক সাজা পায়? ক’টি ক্ষেত্রে ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত করানো যায়? রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা ধর্ষণে অভিযুক্ত হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করতে পুলিশ অনীহা প্রকাশ করে কেন? ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে কবে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে ভারতীয় নারীরা? কবে সুনিশ্চিত হবে দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা? অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের দ্বারা ধর্ষিতার পরিবারকে হুমকির মুখে পড়তে হয় কেন— এই প্রশ্নগুলো তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। ২০১২ সালে দিল্লিতে চলন্ত বাসে তরুণীর উপরে ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতনের পর মৃত্যুর ঘটনা থেকে শুরু করে তেলঙ্গানার পশুচিকিৎসক তরুণীকে গণধর্ষণ ও পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে খুন করার ঘটনায় যখন তোলপাড় আসমুদ্রহিমাচল।
যে উন্নাও খবরের শিরোনামে এসেছিল চাকুরীপ্রার্থী এক নাবালিকা অসহায় কিশোরীর উপর উপর্যুপরি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে এবং কিশোরীটির পরিবারকে কার্যত নিঃশেষ করে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ওখানকার শাসকদলের প্রভাবশালী বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার, ঠিক সেখানেই অতিসম্প্রতি ঘটে গেল একই রকম নারকীয় ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষিতা তরুণীকে গলায় ছুরির কোপ মেরে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ মেয়েটি মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে না পেরে জীবনযুদ্ধের খেলায় হেরে গিয়েছে। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ২০১৪ সালে ঘটে যাওয়া মধ্যমগ্রাম গণধর্ষণের ঘটনাকে। দু’টি ঘটনার চিত্রনাট্যেও হুবহু সাদৃশ্য চোখে পড়ে। সে ক্ষেত্রেও গণধর্ষিতা নাবালিকা কিশোরীকে থানায় অভিযোগ জানানোর কারণে আক্রোশ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পুনরায় গণধর্ষিতা হতে হয় ও জোরপূর্বক আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। যার পরিণামে নেমে আসে মৃত্যু। অতি সম্প্রতি মালদহে আম বাগানে এক যুবতীকে ধর্ষণের পরে একই ভাবে অগ্নিদগ্ধ করে মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ সামনে এসেছে। রাঁচির ২৫ বছর বয়সী আইনের পড়ুয়া ছাত্রীর উপরে পাশবিক গণধর্ষণের ঘটনায় ১২ জন অভিযুক্তের সকলেই গ্রেফতার হয়েছে।
এই ঘটনাগুলির একটিও প্রচারের আলোকপ্রাপ্তি ঘটেনি, তাই আমাদের বিবেকও এখানে থেকে গিয়েছে নিষ্প্রভ এবং স্বাভাবিক ভাবেই মোমবাতির শিখাও জ্বলেনি পথে পথে। দেশজুড়ে ধর্ষণ বৃত্তের পরিধি ক্রমশ বাড়তেই থাকছে। ধর্ষণবৃত্তের পরিধিস্থ এক একটি বিন্দু যদি হয়— দিল্লি, উন্নাও, সামশাবাদ, বিহারের বক্সার, রাঁচি, কাঠুয়া, কামদুনি, পার্কস্ট্রিট, মধ্যমগ্রাম, মালদহ….তা হলে বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে অনিবার্য ভাবেই অবস্থান করে ধর্ষক-নরখাদকের দল। এই বৃত্তের পরিধিতে প্রায় প্রতি দিনই সংযোজিত হয়ে চলেছে নতুন নতুন ধর্ষণের ঘটনা। কত ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অর্ধেক আকাশের গুমরে ওঠা বোবা কান্নায় নীরবে শেষ হয়ে যায় কত-শত নারীর অবশিষ্ট জীবন, তার ইয়ত্তা নেই। বিচারপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে কবে উপযুক্ত সাজা পাবে অপরাধীরা? কারও জানা নেই তার সঠিক উত্তর। উন্নাওয়ের নির্যাতিতা মৃত কিশোরীর বাবাও স্বভাবতই তেলঙ্গানার ঘটনার ন্যায় অভিযুক্তদের এনকাউন্টারের দাবি তুলেছেন। তা হলে দেশের আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে শাস্তিপ্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশই কি হয়ে উঠবে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা? এই এনকাউন্টারই কি ধর্ষকদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে নিদর্শন হয়ে উঠবে, না কি আমরা ভরসা রাখব ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপর?
বরং আমরা কি দাবি তুলতে পারি না, ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতি দ্রুততার সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কঠোরতম শাস্তিপ্রদানের জন্য নতুন আইন প্রবর্তন করা হোক। ধর্ষণ একপ্রকার সামাজিক ব্যাধি। এই সামাজিক ব্যাধিকে দেশ থেকে নির্মূল করতে হলে বিকৃতকাম ধর্ষকদের অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিদর্শন রাখতে হবে। যা প্রত্যক্ষ করে যাতে ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায় মানুষরূপী পশুদের। ভয়ঙ্কর অন্তিম পরিণতির কথা ভেবে কোনও নারীর উপরে এই ধরনের পাশবিক নির্যাতন করার আগে অন্তত যাতে শতসহস্র বার ভাবে নরখাদকের দল। তবেই হয়তো এই ব্যাধির শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে সমাজের বুক থেকে চিরতরে।
আগামীতে পথে-ঘাটে-প্রান্তরে নরখাদকরূপী শ্বাপদ সঙ্কুল বিবর্জিত এক সুন্দর চিত্রিত দেশের স্বপ্ন কি দেখতে পারি না আমরা?
লেখক: শক্তিনগর হাইস্কুলের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy