অমিত মিত্র মানিতে চাহিবেন না। কিন্তু অর্থ কমিশনের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যাহা বলিয়া গেলেন, তাহা তিরস্কার বই আর কী? কমিশনের প্রধান জানাইয়াছেন, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার সহিত কাজ করিয়া আগামী মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে বেশ কয়েকটি আর্থিক সূচকের মান নূতন ভাবে জানাইতে হইবে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যানের উপর যে অর্থ কমিশনের ভরসা নাই, সেই কথাটিতে কার্যত সরকারি সিলমোহর পড়িল। ভরসার অভাব অবশ্য পূর্বেও চক্ষে পড়িয়াছিল। গত অর্থবর্ষের জন্য প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেশের সব রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিসংখ্যান ছিল। ব্যতিক্রম কেবল পশ্চিমবঙ্গ। সমীক্ষা জানাইয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যানগুলিকে ফের খতাইয়া দেখা হইতেছে। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের মুখে গত কয়েক বৎসরে রাজ্যের পরিসংখ্যান বিষয়ে বিবিধ অভিযোগ শোনা গিয়াছে। তাহার মূল কথা, পশ্চিমবঙ্গের সরকারপ্রদত্ত পরিসংখ্যানের উপর ভরসা করা মুশকিল। কথাটির মধ্যে কয় আনা সত্য আছে, আর কতখানি বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, সেই তর্কে ঢোকা অর্থহীন। রাজ্য সরকার যে পরিসংখ্যান পেশ করিতেছে, তাহার উপর গবেষকদেরও যেমন আস্থা নাই, সরকারি মহলেরও নাই— ইহাই মূল বিবেচ্য। রাজ্যের উন্নয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব কতখানি, অমিত মিত্রদের তাহা নূতন করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক এক অর্থে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের ন্যায়— শরীরের কোথায় কোন রোগ বাসা বাঁধিয়া আছে, তাহা বুঝিতে চাহিলে নির্ভুল রিপোর্টের বিকল্প নাই। রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য অতি উত্তম, এই কথাটি বুঝিবার জন্যও তো স্বচ্ছ পরিসংখ্যান থাকা জরুরি।
অর্থমন্ত্রী উত্তরে বলিতেই পারেন যে অর্থ কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসাও করিয়াছে। কথাটি অস্বীকার করিবার নহে। রাজস্ব বৃদ্ধি বা ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাজ্য যে উন্নতি করিয়াছে, অর্থ কমিশনের প্রধান এন কে সিংহ তাহা জানাইয়াছেন। মূলধনী খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও উন্নতি হইয়াছে। এই প্রশংসার সহিত পরিসংখ্যানের অভাবের তিরস্কারের কোনও বিরোধ নাই, এই কথাটি যদি সরকার বুঝিয়া লয়, তাহা হইলে মঙ্গল। বাস্তব হইল, শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই নহে, গোটা দেশের পরিসংখ্যান লইয়াই বিদ্বৎসমাজে কিছু প্রশ্ন তৈরি হইতেছে। ইহা অর্থনীতির বাস্তবের সহিত রাজনীতির প্যাঁচপয়জারের বিপজ্জনক সঙ্গমস্থল। রাজনীতি যাহা বলিতে চাহে, পরিসংখ্যানের মুখ দিয়া সেই কথাটি বলাইয়া লওয়ার প্রবণতা অল্পবিস্তর সর্বত্রই বর্তমান। তাহাতে রাজনীতির সাময়িক লাভ হইতে পারে, কিন্তু অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। কারণ, রাজনীতির ঘূর্ণিতে প্রকৃত তথ্যটি যদি ভাসিয়া যায়, তবে আর্থিক নীতিও দিকভ্রষ্ট হইতে বাধ্য। চাঁদমারিটি যদি চক্ষেই না পড়ে, তিরন্দাজের সাধ্য কী লক্ষ্যভেদ করে! পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যান লইয়া প্রশ্ন উঠিতেছে। আশা করা যায়, পরিসংখ্যানে গোলমাল যদি থাকেও, তাহা রাজনীতিসঞ্জাত নহে। অর্থাৎ, তাহা ভুলমাত্র, কোনও অভিসন্ধি ছাড়াই। তেমন ভুল শুধরাইয়া লওয়া যায়। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার সাহায্য পাওয়া গেলে সংশোধনের কাজটি গতিপ্রাপ্ত হইবে বলিয়াই আশা। সরকার যদি অগস্ট মাসের মধ্যে ভুলগুলি শুধরাইয়া লয়, তবে স্পষ্ট হইবে যে সেই ভুলের পিছনে কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy