হলিউডের অনেকগুলি রোমাঞ্চকর ছায়াছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী কখনও ভিনদেশি সন্ত্রাসবাদী, কখনও ভিনগ্রহের প্রাণী। বাস্তবে বিশ্বের সম্মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ হইয়া দাঁড়াইল ক্ষুদ্র মানবশিশু। তাহাদের কান্না বলদর্পী প্রেসিডেন্টকে পিছু হটিতে বাধ্য করিল। গত এক মাস মেক্সিকো সীমান্তে শরণার্থী শিশুদের পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার নীতি অনুসরণ করিয়াছে মার্কিনরা। বাবা-মায়েদের কয়েদ করিয়াছে। শিশুদের স্থান হইয়াছে ‘খাঁচা’র ভিতরে। এমন মনোরম ব্যবস্থায় শিশুরা ভোলে নাই, বাবা-মায়ের জন্য কান্না জুড়িয়াছে। সমবেত সেই ক্রন্দনধ্বনির সম্প্রচার সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলিয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিও তোলপাড়। ঘরে-বাইরে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হইয়াছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরাই কেবল নহে, রিপাবলিকান সেনেটররাও প্রতিবাদে সরব হইয়াছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ হইতে ক্যাথলিক চার্চ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন হইতে চার জন প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি, সকলেই এই অমানবিক নীতি স্থগিত করিবার আর্জি করিয়াছেন। ট্রাম্প স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্যে ঘোষণা করিয়াছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি ‘শরণার্থী শিবির’ হইয়া উঠিতে দিবেন না। তাহাতে দেশে অপরাধ বাড়িবে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য অবস্থান বদলাইয়াছেন। গোটা পরিবারকে একত্রে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে রাখিবার নির্দেশ জারি করিয়াছেন। কিন্তু যে শিশুরা ইতিমধ্যেই পরিবার-বিচ্ছিন্ন হইয়াছে তাহাদের ভবিতব্য এখনও স্পষ্ট নহে। এবং নিশি না পোহাইতে ট্রাম্পের নীতি উল্টাইয়া যাইবে না, এমন গ্যারান্টিও, আর যাহাই হউক, ট্রাম্পের দেশে কেহ দিতে পারিবে না।
অভিবাসন নীতি লইয়া প্রথম বিশ্বের দেশগুলি চরম অস্বস্তিতে। ইউরোপে সেই সঙ্কটের রূপটি ইতিমধ্যেই পরিস্ফুট। তিন বৎসর পূর্বে সিরিয়ার যে শিশুর প্রাণহীন দেহ মিলিয়াছিল তুরস্কের সাগর তীরে, তাহার লাল জামাটি কে ভুলিতে পারিয়াছে? উদ্ভ্রান্ত হিংসা, নিশ্চিত মৃত্যু হইতে পরিবারকে বাঁচাইতে শত শত মানুষ নিজের দেশ হইতে ভিনদেশে পাড়ি দিতেছেন। তাঁহাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করিবার অর্থ কার্যত বাঁচিবার অধিকার বাতিল করা। দেশের সীমান্তে প্রবেশের নীতি স্থির করিবে রাষ্ট্র, সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’, এই নীতিকে অগ্রাহ্য করিয়া আইন করিলে তাহা নূতন নূতন সঙ্কট তৈয়ারি করিবেই। দক্ষিণ আমেরিকার অশান্ত, হিংসাদীর্ণ দেশগুলি হইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীর ভিড় নূতন নহে। বেআইনি প্রবেশকারীদের কারারুদ্ধ করিবার রীতিও বরাবরই প্রচলিত। কিন্তু শিশুদের কারারুদ্ধ করা যে হেতু নিষিদ্ধ, তাই শিশু-সহ পরিবার ধরা পড়িলে প্রাপ্তবয়স্কদেরও বন্দি করিত না প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। অভিবাসন-সংক্রান্ত মামলার শুনানির জন্য নিয়মিত আদালতে উপস্থিত থাকিবার নির্দেশ দিয়া তাহাদের মুক্ত করা হইত।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার মাসখানেক পূর্বে উদ্বাস্তুদের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি লইবার ফলে সঙ্কট তীব্র হইয়াছে। সরকার প্রাপ্তবয়স্কদের কয়েদ করিবেই, অতএব শিশু-সহ পরিবার আসিলে শিশুদের অন্যত্র রাখিতে হইতেছে। ইহার ফলে মাত্র এক মাসে প্রায় দুই সহস্র শিশু পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। ট্রাম্প সরকারের বক্তব্য, ইহাই আইন, না মানিয়া উপায় নাই। সমালোচকদের বক্তব্য, বেআইনি প্রবেশকারীর শাস্তির নির্দেশ থাকিলেও, শিশুদের পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন করিতেই হইবে এমন আবশ্যকতা নাই। ট্রাম্প সরকার সম্ভবত উদ্বাস্তুদের নিরস্ত করিতে এমন অমানবিক কাজ করিতেছে। শিশুকে হারাইবার ভয়ে যাহাতে শরণার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশদ্বারে না আসে। ইহার অপেক্ষা অমানবিক কী হইতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy