Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
জলাধার যথেষ্ট খালি হয়নি, প্লাবনের ভয় প্রবল
Flood

বৃষ্টি ধরার জায়গা নেই

গঙ্গাক্ষেত্রের আর একটি বাঁধ গাঁধীসাগর। চম্বল নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধের কিছুটা নীচেই চম্বল ঘড়িয়াল (মেছো কুমির) স্যাংচুয়ারি। সরকার সারা বছর বলে, এখানে জলাভাবের কথা। বর্তমান বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই জলাধারের লাইভ স্টোরেজে জমা থাকা জলের পরিমাণ ১১৫৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। চম্বল বেয়ে যমুনায় যে জল আসার কথা, তা থেকে বঞ্চিত থাকে যমুনা, ফলত গঙ্গা।

শুষ্ক  নদী।

শুষ্ক নদী।

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৮ ০০:০৬
Share: Save:

সম্ভবপরের জন্যে সব সময়েই প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা পৃথিবীতে সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত...।— রবীন্দ্রনাথ

প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়ম অনুযায়ী এ দেশে আষাঢ় থেকে আশ্বিন, থুড়ি জুন থেকে সেপ্টেম্বর, বর্ষাঋতু। সারা বছরে যতটা জল ঝরার কথা, তার শতকরা আশি ভাগ এই ক’মাসের মধ্যেই মাটিতে নেমে আসবে। এই নিয়ম যে হেতু বরাবর চলে আসছে, তাই এখানকার লোকেরা বেশ পুরনো আমল থেকেই তৈরি থাকতেন ওই চার মাসের মধ্যে সারা বছরের প্রয়োজনীয় জলের সঞ্চয় ব্যবস্থা পাকা করে নিতে। নাগালের মধ্যে, ঘরের কাছে জল জমা রাখার যে সব জায়গা, সেই পুকুরগুলোকে বসন্তকালের শেষেই সাফসুতরো করে গভীর করে রাখা হত, যাতে কাছাকাছির মধ্যে ঝরে পড়া বৃষ্টিজলের বেশির ভাগটাই সেখানে সঞ্চিত হতে পারে। অ-জলকালে পুকুররূপী সেই মাটির পাত্রগুলো যেন মানুষ-পশুপাখির স্নানপানের জল রাখে। নদী চলত তার নিজের নিয়মে— সারা বছরের শুকিয়ে ওঠা ধারার বুকে যতখানি বালি-পলি জমা হত, বিপুল বর্ষণে দুই পার থেকে গড়িয়ে আসা জল তীব্র স্রোতে নদীখাত ধুয়ে সেই জমা মাটি ঠেলে দিত আরও নীচে। কিছু বা বন্যার ছলে দুই তীরে ছড়াত পলির উর্বরতা।

স্বাধীন দেশে অসংখ্য নদীবন্ধনে বারে বারে অনিয়ন্ত্রিত জলপ্রলয়ের পর শেষ পর্যন্ত ‘সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন’ নামে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরি হয়েছে, যাদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ জলঘটিত যাবতীয় দায়িত্বের ভার। সেই সকল দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম হল, সারা দেশে নির্মিত অসংখ্য নদীবাঁধের পিছনে বৃহৎ জলাধারগুলোয় জমা জলের হিসাব রাখা। বিভিন্ন রাজ্যে স্থিত এই সব জলাধারের জল বৃষ্টিবিহীনতার কালে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, বর্ষার পূর্বনির্দিষ্ট সময়ের আগে সেগুলি আসন্ন বর্ষার অতিরিক্ত জল ধরার জন্য প্রস্তুত কি না, এ সব সম্ভাব্য সমস্যার বিষয়ে মানুষকে ওয়াকিবহাল রাখার মানসে এই কমিশন প্রতি বৃহস্পতিবারে বিভিন্ন বাঁধের জলাধারে জলের পরিস্থিতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক বিজ্ঞপ্তি দেয়। প্রায় প্রতি বছর বন্যার তাণ্ডবে যাঁদের ধনসম্পদ, ঘরবাড়ি, এমনকি প্রাণ ধ্বংস হয়, তাঁদের কাছে অন্তত এই সূচনালাভের খবরটি ভরসাব্যঞ্জক।

কিন্তু সেই আশা নিয়ে যাঁরা এই বিজ্ঞপ্তি লক্ষ করবেন, কী পাবেন তাঁরা? এ বছরের ৩১ মে পর্যন্ত দেশময় ছড়ানো বিভিন্ন প্রধান নদীর অববাহিকায় স্থিত যে সব প্রকাণ্ড জলাধার আছে, সেগুলোতে সঞ্চিত জল খালি হওয়ার অবস্থা কী রকম?

একটা বাঁধের জলাধারে দু’টি অংশ থাকে: ডেড স্টোরেজ আর লাইভ স্টোরেজ। সংক্ষেপে, ডেড স্টোরেজ হল জলাধারের গভীর অংশ। এখানে জমা থাকা জল যাতায়াত করে না। তার উপরিতলে জলের বাড়া-কমা করতে থাকা অংশটিকে বলা হয় লাইভ স্টোরেজ। ৩১ মে ৯১টি বৃহৎ জলাধারের জলের পরিস্থিতি জানানো হয়েছে, তাদের মিলিত জল ধারণ ক্ষমতা ১৬১.৯৯৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। দেশের আঠারোটি রাজ্য জুড়ে বারোটি বড় নদীর অববাহিকায় এই ৯১টি জলাধার অবস্থিত। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী উক্ত জলাধারগুলির অধিকাংশেই বর্তমানে সঞ্চিত জল লক্ষ্যমাত্রার অনেক উপরে। অর্থাৎ জুনের প্রথম সপ্তাহে বর্ষা আসন্ন জেনেও এই বিশাল জলাধারগুলিতে এসে পড়া বৃষ্টিজল ধরার যথেষ্ট জায়গা করা হয়নি। অথচ প্রতিটি নদী জলাভাবে ধুঁকছে। ৩১ মে’র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী উক্ত ৯১টি জলাধারে জমা থাকা জলের মোট পরিমাণ ২৭৬৫৯ মিলিয়ন কিউবিক মিটার, তার দুই-তৃতীয়াংশ জমা আছে মাত্র ২৮টিতে। তার মধ্যে সাতটি বড় বাঁধের জলাধারে রয়ে গিয়েছে ১০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি জল।

যেমন, শোণ নদীর ওপর তৈরি বাণসাগর জলাধারে এখনই লাইভ স্টোরেজের পরিমাণ ২২২৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এটি গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত বাঁধ। এতখানি জল জমা রয়েছে, যদিও গঙ্গায় জলের ঘাটতি বিপজ্জনক। বহু জায়গায় লোকে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। ঠিক ভাবে জলাধারের জল নদীতে ছাড়া হতে থাকলে নদীর নিম্নপ্রবাহে অথবা শাখানদীগুলিতে জলাভাবজনিত দুরবস্থা হত না। প্রসঙ্গত, ২০১৫-১৬’তে এর চেয়ে কম, ১৮০৯ মিলিয়ন কিউবিক মিটার, জল জমা থাকলেও বিহার মধ্যপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশের মাঝখানে নির্মিত এই বাঁধের জলাধার বর্ষার এসে পড়া জল সামলাতে অক্ষম হয়। ২০১৬ সালের ১৯ অগস্ট সকালে প্রতি সেকেন্ডে ১৬,০০০ কিউবিক মিটার জল ঝড়ের গতিতে শোণের বুকে নেমে এসে বিহারে তাণ্ডব চালায়।

গঙ্গাক্ষেত্রের আর একটি বাঁধ গাঁধীসাগর। চম্বল নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধের কিছুটা নীচেই চম্বল ঘড়িয়াল (মেছো কুমির) স্যাংচুয়ারি। সরকার সারা বছর বলে, এখানে জলাভাবের কথা। বর্তমান বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই জলাধারের লাইভ স্টোরেজে জমা থাকা জলের পরিমাণ ১১৫৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। চম্বল বেয়ে যমুনায় যে জল আসার কথা, তা থেকে বঞ্চিত থাকে যমুনা, ফলত গঙ্গা।

নর্মদা অববাহিকায় নির্মিত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বাঁধগুলোর কয়েকটি। তবুও গুজরাত শুষ্ককণ্ঠ, জলশূন্য নদী, জায়গায় জায়গায় মৃতের পারলৌকিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জল পর্যন্ত অমিল। অথচ এই প্রাকবর্ষায় নর্মদার উপরে বার্গি ও ইন্দিরা সাগর বাঁধের জলাধারের মিলিত লাইভ স্টোরেজের সঞ্চয় ২৫৭০ মিলিয়ন ঘন মিটার জল।

অনেকেরই মনে আছে কী পরিমাণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েও এই বাঁধগুলি নির্মাণ করা হয়, প্রধানত এই যুক্তিতে যে, এদের জলাধারসমূহ শুখার দিনে নদীতে জলপ্রবাহ বজায় রাখবে এবং বর্ষায় সঞ্চয় করে রাখবে অতিরিক্ত জলসম্পদ। তা হলে কেন সদ্য-প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি এমন উদ্বেগজনক ছবি সামনে আনে? সাধারণ বুদ্ধিতেও বোঝা যায়, এই অবস্থার অনিবার্য পরিণতি স্বাভাবিক বৃষ্টিতেও বাঁধগুলোর জলধারণের অক্ষমতা, নদীগুলোতে ভয়াবহ বন্যা।

কী কারণ হতে পারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সর্বাধিক জল নদীধারায় ছেড়ে না দেওয়ার? কমিশন কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা এই রিপোর্ট তৈরি করেন ‘বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী’। অর্থাৎ, জল ছাড়া বা সঞ্চয়ের শৃঙ্খলায় তাঁদের কোনও নজরদারি ভূমিকা নেই।

আসন্ন বর্ষার মুখে আমরা শঙ্কিত এই জলাধার খালি না হওয়ার এবং তার ফলে স্বাভাবিক বৃষ্টিতেও বন্যার আশঙ্কায়। আমাদের রাজ্যে এখনও বড় বাঁধ খুব বেশি নেই বটে, কিন্তু ভারতের বৃহত্তম নদীটির শেষ প্রান্তে আমরা থাকি, এর ধারা বেয়ে যত শুষ্কতা, যত জলপ্লাবন গড়িয়ে নামে, সব যায় এই নিচু জমির বুকের উপর দিয়ে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, বা তার চেয়ে উত্তরে পশ্চিমে কিংবা পূর্বে নির্মিত বাঁধগুলির জলাধারে ২০১৮-র বর্ষা শুরু হয়ে যাওয়া বর্ষার জল ধারণের জায়গা যদি না থাকে, তা হলে ২০১৬ সালে বাণসাগর বাঁধের কারণে বিহারের উপর নেমে আসা দুর্ভাগ্য কয়েক গুণ বেশি হয়ে বিহার ও বাংলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, এ কথা নিশ্চিত বলা যায়।

এই বিশৃঙ্খলার ছবি থেকে সরকারের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে শোচনীয় সংযোগহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ, কোনও অঞ্চলের প্রশাসন চাইলে এই বিপদসম্ভাবনা এড়াতে পারেন। ঝাড়খণ্ডের তেনুঘাট প্রকল্প থেকে জমা অতিরিক্ত জল জুন মাসের ৪ তারিখ নদীতে ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই জলাধারের নিম্নাংশে এখন জলডুবির সম্ভাবনা কম।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রাকৃতিক সম্পদকে করদাতাদের অর্থে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখার কিছু দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের উপরেও বর্তায় না কি? দুর্যোগের পর সেই বিখ্যাত ‘চতুর্থ স্তম্ভ’-এর ভূমিকা যদি বিপদের আগে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে একটু দেখা যেত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flood Dam Monsoon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE