Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দর্শকের আসনে

দুর্বল দেশকে আপন ক্ষমতার বলয়ে আনিবার চেষ্টা করিলে এক কালে বিশ্ব ধিক্কার জানাইত। ঠান্ডা যুদ্ধের কালে দীর্ঘ দিন সেই বদনাম কুড়াইয়াছে সোভিয়েত ও মার্কিন সরকার। বর্তমানে দুনিয়া পাল্টাইয়াছে, এখন মোটের উপর যে যেমন খুশি ছড়ি ঘুরাইতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৪৬
Share: Save:

সাড়ে তিন বৎসব পূর্বে ভারতপন্থী মৈত্রীপাল সিরিসেনা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হইবার পরে ছেদ পড়িয়াছিল এক দশকের চিনা বাণিজ্যিক প্রকল্পে। তবে সেই ছেদ সাময়িক হইতে পারে— এই আশঙ্কা টের পাইয়া গত বৎসরের মাঝামাঝি দ্বীপরাষ্ট্র সফরে গিয়াছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই কূটনীতি যে সফল হয় নাই, তাহার প্রমাণ শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সাংবিধানিক সঙ্কট। ভারতবন্ধু প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘেকে বরখাস্ত করিয়া সিরিসেনা বহাল করিয়াছেন চিনবন্ধু প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে। বিচ্ছেদের প্রথম কারণ শ্রীলঙ্কায় চিনের অর্থলগ্নির অঙ্কের সহিত ভারত আঁটিয়া উঠিতে পারিতেছে না। দ্বিতীয় কারণ নীতিপঙ্গুত্ব। সঙ্কটের পরে এক সপ্তাহ অতিবাহিত হইলেও কার্যত ‘পর্যবেক্ষণ’ ব্যতীত অপর কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই বিদেশমন্ত্রক। বস্তুত, বর্তমান বিদেশ নীতিতে ভারতের অপারগতার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা নমুনামাত্র। আর এক প্রতিবেশী মলদ্বীপে ২০১১ সালের পূর্বে চিনের দূতাবাস পর্যন্ত ছিল না, অথচ ২০১৮’য় মলদ্বীপ সরকারের উপর চিনের দীর্ঘ ছায়া স্পষ্ট প্রতীয়মান।

দুর্বল দেশকে আপন ক্ষমতার বলয়ে আনিবার চেষ্টা করিলে এক কালে বিশ্ব ধিক্কার জানাইত। ঠান্ডা যুদ্ধের কালে দীর্ঘ দিন সেই বদনাম কুড়াইয়াছে সোভিয়েত ও মার্কিন সরকার। বর্তমানে দুনিয়া পাল্টাইয়াছে, এখন মোটের উপর যে যেমন খুশি ছড়ি ঘুরাইতে পারে। সেই সুযোগ লইয়া অপর দেশকে সহায়তা করিবার নামে তাহার প্রশাসনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিতেছে চিন। জ়িম্বাবোয়ে হইতে কেনিয়া পর্যন্ত আফ্রিকার বহু দেশে পরিকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞে সহায় হইয়াছে বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি। চিনের ঋণ ও প্রযুক্তি উন্নয়নের কাজে লাগাইতেছে সংশ্লিষ্ট সরকার। শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপও তদ্রুপ। কলম্বো বন্দর নির্মাণের সহিত সংলগ্ন জলভাগে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণের পরিকল্পনা করিয়াছে চিন, নূতন সড়ক ও রেলপথেও ভরসা তাহারাই। গত ডিসেম্বর চিনের সহিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করিয়াছিল মলদ্বীপ। আপন অর্থনীতিকে বলীয়ান করিতেই চিনের প্রতি আগ্রহী হইয়াছে ভারতের দুই প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র।

এবং চিন যাহা করিতেছে, ভারত তাহা পারিতেছে না। তাহার সাধ আছে, সাধ্য নাই। না আছে অর্থনৈতিক সাধ্য, না কূটনৈতিক সামর্থ্য। পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে তিক্ত হইয়াছে, সেই প্রসঙ্গ না হয় ছাড়িয়াই দেওয়া গেল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ প্রতিবেশীর সহিত ভারতের সম্পর্ক অধোগতির পথে। এমনকি স্বাভাবিক মিত্রদের সহিত ভারতের সম্পর্ক মোদী সরকারের জমানায় মন্দ হইয়াছে, রাশ আলগা হইয়াছে ভারতের প্রভাব ক্ষেত্রে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করিয়াছে চিন। প্রশ্ন উঠিতে পারে, ভারতে কি বিচক্ষণ কূটনীতিক কম পড়িয়াছে? সম্ভবত নহে। হয়তো এই ব্যর্থতার মূলে রহিয়াছে এককেন্দ্রিকতা এবং অহঙ্কার। অর্থনীতি হইতে স্বরাষ্ট্রনীতি, সব ক্ষেত্রেই এক ব্যক্তি বা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া থাকেন বলিয়া অন্য কেহ কিছু বলিবার সাহস করেন না। তাঁহারা আপন কর্তৃত্ব সম্পর্কে অতিমাত্রায় অহঙ্কারী, ফলে বৃহত্তর মহলের পরামর্শ লইতে নারাজ। অথচ নিজেদের বিবেচনাবোধ যথেষ্ট নহে। অবশ্যম্ভাবী ফল: ভারত সর্বত্র দর্শকের আসনে স্থানান্তরিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE