জন্মদিনটি মনে রাখার মতো। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্ম ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, মধ্যপ্রদেশের গ্বালিয়র শহরে। ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাইবোন। বাবা কৃষ্ণবিহারী ছিলেন স্কুলের শিক্ষক, হিন্দু শাস্ত্রে পারঙ্গম। ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আদর্শে প্রাণিত ছিলেন বাজপেয়ী। মাঝে বাঁ দিকে ঝুঁকেছিলেন। সদস্য হন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশনের। তবে অল্প দিনই, অচিরে সঙ্ঘে ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়েন, ২৪ দিনের সংক্ষিপ্ত হাজতবাসও হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরে লখনউয়ে আইন পড়তেও শুরু করেছিলেন। কিন্তু আরএসএসের পত্রিকা সম্পাদনার ডাক পেয়ে পড়ায় ইতি টানেন। কবিতা লেখার শখও তখন থেকেই। তাঁর কয়েকটি পদ্যের বই আছে, অধিকাংশই দেশাত্মবোধক। সেগুলির দু’একটিতে সুর লাগিয়ে নামী শিল্পীরা গেয়েওছিলেন, অবশ্য তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের যুগে।
তরুণ অটলবিহারী ভেবেছিলেন, সাংবাদিক হিসেবেই সঙ্ঘের আদর্শ প্রচার করে যাবেন। কিন্তু, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘ভুল করে’ রাজনীতিতে চলে আসেন। ১৯৫১ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘে যোগ দেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন। ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ যখন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাশ্মীর অভিযান করেন, তখন অন্য দুই প্রবীণ সহযোগীর সঙ্গে বাজপেয়ীও তাঁর সঙ্গী ছিলেন। কাশ্মীরে প্রবেশের মুখে গ্রেফতারি অনিবার্য জেনে শ্যামাপ্রসাদ এই তরুণ সচিবকেই সঙ্গে নেন, যিনি তাঁর বৌদ্ধিক সহযোগী ও পরামর্শদাতা হওয়ার যোগ্য। শ্যামাপ্রসাদের প্রয়াণ তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে আনে। ’৫৭ সালে তিনি জনসঙ্ঘের সভাপতি। নির্বাচিত হলেন লোকসভাতেও। শুরু হল পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ সাংসদ (ছ’বার লোকসভার এবং দু’বার রাজ্যসভায়) জীবন।
প্রথম বার যখন বাজপেয়ী লোকসভায় যান, প্রধানমন্ত্রী সে সময় জওহরলাল নেহরু। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুগ্ধ হয়ে নেহরুর বক্তৃতা শুনতেন। কখনও কোনও লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেননি বাজপেয়ী। তাঁর বক্তৃতা ছিল শ্রুতিসুখকর, উর্দু ও ফারসি-বহুল আলঙ্কারিক হিন্দি এবং নাটকীয় অঙ্গভঙ্গিতে ভরা। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর হিন্দি ভাষণ দুনিয়ার নজর কাড়ে। তার আগে, ইন্দিরা গাঁধীর সময়েই সংসদে বিরোধী নেতা হিসাবে বাজপেয়ীর প্রসিদ্ধি। অতঃপর জরুরি অবস্থা পার হয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘জনতা বিপ্লব’-এর পথ বেয়ে তিনি জনতা সরকারের বিদেশমন্ত্রী। সেই থেকে ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র।
১৯৮০ সালে বাজপেয়ীর পৌরোহিত্যেই ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম। কিন্তু ভারতীয় জনসঙ্ঘ যে কট্টর হিন্দুত্বের সাধনায় নিরত ছিল, বিজেপিকে তার উত্তরসাধক করার চেষ্টা তিনি করেননি। অনেকের মতে, সে কারণেই বিজেপির সংসদীয় শক্তি দুইয়ে নেমে এসেছিল, রামমন্দিরের পথ ধরে রামরথে চড়ে তাকে শক্তি দেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। রামজন্মভূমি আন্দোলনের বিভাজনী রাজনীতিতে বাজপেয়ীর নাকি তেমন সায় ছিল না, কিন্তু দলের লড়াই-খ্যাপাদের নিরস্ত করতে পারেননি। দৃশ্যত, চেষ্টাও করেননি— কেবল মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে দায় সেরেছিলেন।
১৯৯৬ সালে তেরো দিনের প্রধানমন্ত্রিত্বের কথা ছেড়ে দিলে, ১৯৯৮ সালে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত প্রথম সরকার গঠনের সময় শরিক দলগুলির দাবিতে নরমপন্থী বাজপেয়ীর ভাগ্যেই প্রধানমন্ত্রিত্বের শিকেটি ছিঁড়ল। অতঃপর নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ সরকারের আর্থিক সংস্কারের পথে চললেন বাজপেয়ী। বৈপ্লবিক বা যুগান্তকারী কোনও পরিবর্তনের ডঙ্কা না বাজিয়ে ভেসে থাকার দক্ষতা তাঁর ভালই আয়ত্ত ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী হয়েই পোখরানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ অবশ্যই তাঁর বড় সিদ্ধান্ত। এবং তার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম দুনিয়ার চাপ সামলে ভারতের বিদেশ নীতিকে একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব ইতিহাস তাঁকেই দেবে। কিন্তু তাঁর ইতিবাচক পাকিস্তান নীতি পারভেজ় মুশারফের ধূর্ততার কাছে পরাস্ত হয়, ঐতিহাসিক লাহৌর বাস-যাত্রার কূটনৈতিক গুরুত্বকে লাঞ্ছিত করে কার্গিল সংঘর্ষ।
তবে পদ্মবিভূষণ (১৯৯২) এবং ভারতরত্ন (২০১৫) অটলবিহারীর সব চেয়ে বড় নৈতিক পরাজয় সম্ভবত ২০০২ সালে। গোধরা-উত্তর গুজরাতে সংখ্যালঘুদের গণ-নিধনের পরে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী, কিন্তু সেই পরামর্শ পালনে মোদীকে বাধ্য করেননি, এমনকি উপদ্রুত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতেও অযথা বিলম্ব করেন। এর পিছনেও সেই জলে নেমে বেণী না ভেজানোর চেষ্টা— এক দিকে সঙ্ঘ পরিবারের কট্টরপন্থীদের না-চটানোর সতর্ক প্রয়াস, অন্য দিকে জঙ্গি হিন্দুত্ব থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা। এই ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি আচরণের জোরেই তিনি রাজনৈতিক আকাশে নিজেকে দীর্ঘ কাল ভাসিয়ে রাখতে পেরেছেন। এ জন্যই কোয়ালিশন রাজনীতি অনুশীলনে সফল হয়েছিলেন— ফারুক আবদুল্লা থেকে প্রকাশ সিংহ বাদলের মতো হিন্দুত্বে-অস্বস্তি-বোধ-করা নেতারাও তাঁর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারে যোগ দেন। কিন্তু যে নৈতিক স্বীকৃতি থাকলে যথার্থ রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠা যায়, এই নমনীয়তার কারণেই হয়তো সেখানে তাঁর ঘাটতি থেকে গিয়েছিল।
২০০৪ নির্বাচনে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র ফানুসটি ফেটে যায়। বাজপেয়ী পরাজিত হন। শরীর তার আগেই ভাঙতে শুরু করেছে। পরের বছর রাজনীতি থেকে অবসর নেন, ক্রমশ তিনি আক্ষরিক অর্থে অন্তরালে চলে যান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর অভ্যুত্থান সেই অপসরণকে রাজনৈতিক ভাবেও প্রতিষ্ঠিত করে— বিজেপির বাজপেয়ী যুগ শেষ হয়ে শুরু হয় এই মোদী-রাজ। ৯৩ বছর বয়সে অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিদায় সেই অবসানকে সম্পূর্ণ করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy