Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রকৃতির অবাক সৃষ্টি রাঢ়বাংলার ‘বৃক্ষফসিল’

এ রকম গাছ-পাথর দেখতে পাওয়া যায় বীরভূমের বক্রেশ্বর, কোটাসুর, কঙ্কালীতলা, লাভপুর, শান্তিনিকেতনের শ্যামবাটি, গোয়ালপাড়া, আমখই, বামনিগ্রাম-সহ নানা জায়গায়।

পুরাতন: ইলামবাজারের ফসিল পার্কে সংরক্ষিত। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

পুরাতন: ইলামবাজারের ফসিল পার্কে সংরক্ষিত। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:২৪
Share: Save:

ছোটবেলায় সিউড়িতে ‘ছোট বাড়ির’ পিছনে পুকুরের পাড়ে কতগুলো গাছের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখতাম। কাঠের মতো দেখতে হলেও কাঠ নয়, নিরেট পাথর। সেই পাথরের উপরে লাফঝাঁপ দিয়ে খেলাধুলো চলত। একবার রাঁধুনি গৌরদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আচ্ছা গৌরদা এই গাছের গুঁড়িগুলোকে কে পাথর বানাল বলো তো?’ গৌরদা রামচন্দ্রের প্রস্তুরীভূত অহল্যা উদ্ধারের গল্প শেষ করে বলেছিল, ‘এই পাথরগুলোকে হয়তো কোনও তন্ত্রসিদ্ধ মহাপুরুষ পাথর বানিয়েছে।’ কিন্তু মহাপুরুষ এই গুঁড়িগুলোকে খামোকা কেন পাথর বানাতে যাবে, সেটা মাথায় ঢোকেনি। মহিমাদাদুকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, যতদূর মনে পড়ছে ওই পাথরগুলো পুকুর খুঁড়তে গিয়ে উঠেছিল। গাছ পাথরের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়।

এ রকম গাছ-পাথর দেখতে পাওয়া যায় বীরভূমের বক্রেশ্বর, কোটাসুর, কঙ্কালীতলা, লাভপুর, শান্তিনিকেতনের শ্যামবাটি, গোয়ালপাড়া, আমখই, বামনিগ্রাম-সহ নানা জায়গায়। প্রতিটি জায়গাতেই এই গাছ পাথরগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত সব কিংবদন্তি। যেমন কোটাসুরে এই পাথরগুলিকে বলা হয় ভীমের হাতে নিহত হওয়া বকাসুরের হাড়। কঙ্কালীতলায় মায়ের (সতী) কঙ্কালের অবশেষ, আবার কোথাও এটা খুষ্টিগিরির সুফি সাধক বাবা কেরমানি সাহেবের কেরামতি। কিংবদন্তির গল্প যাই হোক না কেন, এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়, রহস্যময় গাছ-পাথর নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কৌতূহলের অন্ত নেই।

বীরভূমের প্রয়াত কবি ও গীতিকার আশানন্দন চট্টরাজের গানেও ধরা আছে এই গাছ পাথরের কথা—

‘আছে লাভপুরে হায় গাছের কান্ড

পাথরে তারা অতি প্রচন্ড

ছিল প্রাচীনকালে মহা অরণ্য

মাটির নিচে হায় পাথর হয়ে পড়ে।’

ভূতাত্ত্বিকভাবে বীরভূমের অবস্থান ছোটনাগপুর মালভূমির অবনমিত ঢালের ক্ষয়ীভূত অংশে। ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রাগৈতিহাসিক মায়োসিন যুগের শেষ পর্বে এই রাঢ় অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হত এক বা একাধিক বিরাট নদী। যে নদীর অভিমুখ ছিল উত্তর পশ্চিম থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে। এই নদীবাহিত কাদামাটি ও পলির দ্বারা গঠিত হয়েছিল রাঢ় বাংলার ভূত্বক। ধীরে ধীরে তা প্রাচীন ও ক্ষয়ীভূত হয়েছে। তাই নরম পলি মাটির স্তর এখন আর খুব গভীর নয়। এর ঠিক নীচেই রয়েছে নুড়ি পাথরের স্তর। আরও গভীরে গেলে পাওয়া যাবে বেলেপাথরের স্তর। নুড়ি পাথরের স্তরের মধ্যেই সাধারণ ভাবে গাছ-পাথরের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

বর্ষায় বৃষ্টির জলে ল্যাটেরাইটের অংশ বা পলি ধুয়ে গেলে এই সব গাছ-পাথরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তা ছাড়া গ্রামেগঞ্জে, রাস্তাঘাটে, পুকুরের ধারে এই গাছ-পাথর নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এক কথায় চেহারার দিক থেকে কাঠের সঙ্গে মিলে গেলেও আদতে তা প্রস্তুরীভূত উদ্ভিদের ফসিল (পেট্রিফায়েড উড)। ল্যাটিনে পেট্রো শব্দের মানে রক-স্টোন। পশ্চিমবঙ্গে এই উদ্ভিজ্জ ফসিল মূলত দেখা যায় বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়।

কিছু বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাইজেল হিউজ বিশ্বভারতীতে থাকাকালীন বীরভূমের বৃক্ষ-ফসিল নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর মতে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লক্ষ বছর আগে ভূতাত্ত্বিক যুগ বিভাগ অনুসারে মায়োসিন থেকে প্লায়োসিন যুগে উত্তরণের সময় কালে বীরভূমের এই রুক্ষ মাটিতে বয়ে চলত এক বিশাল স্রোতস্বিনী। যার প্রবাহ ছিল দক্ষিণমুখী। এই নদীর দুই তীর ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। ‘প্রকৃতির সেই ঘন ঘন মাথা নাড়ার যুগে’, হঠাৎ প্লাবন বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বনের এই সব বৃক্ষ চাপা পড়ে যায়। তারপর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গাছের গুঁড়িগুলো রূপান্তরিত হয় প্রস্তুরীভূত উদ্ভিদ ফসিলে।

এই গাছের গুঁড়ির মতো পাথরগুলোর মধ্যে কতগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন এগুলো দেখতে অবিকল গাছের গুঁড়ির মতো। এতে কাঠের ফাইবারের দাগ ও সুন্দর ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কোন গাছের গুঁড়িতে বল্কের চিহ্ন‌ বর্তমান। এমনকি গাছের কাটা গুঁড়ির মতো বর্ষ বলয়ের সুস্পষ্ট দাগ‌ও পাথরের গায়ে লক্ষ্য করা যায়। গাছ পাথর সাধারণ পাথরের থেকে বেশ কয়েক গুণ ভারী। লম্বা ছোট খন্ডিত পাথরের গায়ে আঘাত করলে মিষ্টি ধাতব শব্দ শোনা যায়।

বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা এই বৃক্ষ-ফসিলগুলি মোটেই হেলাফেলার নয়। ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে তা অত্যন্ত মূল্যবান। কারণ এই পাথরগুলি নিয়ে গবেষণা করে জানা যায় লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ুর পরিবর্তন, মাটিতে খনিজ পদার্থের উপস্থিতির ধরন, পরিবেশ, ভূপ্রকৃতির গঠন, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত নানা মূল্যবান তথ্য। বিষয়টি নিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক গবেষণা চলছে। ফসিল নিয়ে গবেষণার জন্য তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা, যার নাম প্যালিওন্টোলজি। বিভিন্ন দেশে এই মূল্যবান বৃক্ষ-ফসিলগুলি নিয়ে তৈরি হয়েছে ইকোপার্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় তৈরি হয়েছে এক বিশালাকার বৃক্ষ-ফসিল পার্ক ও গবেষণা কেন্দ্র। ইউরোপ ও আমেরিকায় জীবাশ্ম গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছে বিভিন্ন প্যালিওন্টোলজিক্যাল সোসাইটি ও অ্যাসোসিয়েশন, যারা সাধারণ মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে।

আমাদের বীরভূম জেলাতেও শান্তিনিকেতন তথা ইলামবাজারের কাছে আমখই গ্রামে বন দফতরের অধীনে ২০১৭ সাল থেকে চালু হয়েছে একটি বৃক্ষ-ফসিল পার্ক। যেখানে অ্যানজিওস্পার্ম জাতীয় উদ্ভিদের নানা ধরনের ফসিল সংরক্ষিত হয়েছে। যা ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে উদ্ভিদ রূপে বর্তমান ছিল। তবে জেলার নানা স্থানে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা এইসব মূল্যবান ফসিলগুলিকে সংরক্ষণের জন্য স্কুল, কলেজ, ক্লাব ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তারা ফসিলগুলিকে সাজিয়ে ছোট ছোট সংগ্রহশালা তৈরি করতে পারে, যা সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। অতীতের ইতিহাস জানতে ও ভূতত্ত্ববিদ্যা চর্চার মাধ্যম হিসেবে সহজলভ্য এই ফসিলের গুরুত্ব সত্যিই অতুলনীয়।

লেখক আমোদপুর জয় দুর্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tree Fossil
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE