মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হারিলেন। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে এই একটি বাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব। নির্বাচনের এই ফল একটি বৃহৎ শিক্ষা। এবং, কোথায় ভুল হইয়াছে, এখনও না বুঝিলে আর সেই সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাইবেন বলিয়া ভরসা করা কঠিন। বস্তুত, আদৌ আর পাইবেন কি? দেশের বহু অঞ্চলের ভোট যদি নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে-বিপক্ষে গণভোটের চেহারা লইয়া থাকে, অন্তত এই রাজ্যের ভোটে তবে বড় প্রশ্ন ছিল রাজ্যের শাসকদের (অপ)শাসন। বিজেপির পক্ষে এই বিপুল জনসমর্থনের একটি বড় অংশ তাহার প্রতিক্রিয়া। বিশেষত, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া তৃণমূল কংগ্রেস ও তাহার কুক্ষিগত প্রশাসন রাজ্যে যে অনাচার করিয়াছিল, দৃশ্যত বহু ভোটদাতা এই নির্বাচনে তাহার জবাব দিয়াছেন। জবরদস্তি ও সন্ত্রাসের রাজনীতিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। অনুমান করা চলে, বিজেপির পক্ষে জনসমর্থনের ঢেউ এখানেই থামিবে না। এই সত্য তৃণমূল কংগ্রেস তথা তাহার সর্বময়ী নেত্রী কি, এখনও, বুঝিতেছেন? কোনও দিন বুঝিবেন? বুঝিতে চাহিবেন?
অপশাসনের পিছনে রহিয়াছে গভীরতর ব্যাধি। শাসক দলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং ঔদ্ধত্য ও তজ্জনিত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দুর্ভাগ্যের কথা, গত আট বছরে দলের আগাছা সাফাইয়ের কাজ কোনও গুরুত্ব পায় নাই। সিন্ডিকেট হইতে গরু পাচার, অবৈধ বালির ব্যবসা হইতে মাটির চোরাকারবার, বিবিধ অনাচারের সহিত তৃণমূল কংগ্রেসের নাম জড়াইয়া আছে। মানুষ দেখিয়া আসিতেছে। দেখিতেছে, প্রশাসন কী ভাবে দলের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছে, পুলিশের নিরপেক্ষতা ভাসিয়া গিয়াছে খালবিলে। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর দায়। সংখ্যালঘু সমাজের সাধারণ মানুষ সত্যই কতটুকু সুযোগ পাইতেছেন, তাহা বলা শক্ত, কিন্তু ইমাম ভাতা হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাসক দলের নীতি ও আচরণ সম্পূর্ণ অহেতুক ওই তোষণের ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়াছে। ইহাও সুশাসনের লক্ষণ নহে।
বিজেপি শক্তিশালী হইলেই রাজ্যে সুশাসন ফিরিবে, এমন আশা সম্ভবত মানুষের নাই। কিন্তু এই ভোটে তাঁহারা অন্যায় ও অনাচারের প্রতিবাদ করিতে চাহিয়াছেন। বিজেপি তাহার ফসল তুলিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় অর্ধেক আসন নরেন্দ্র মোদীর তহবিলে পৌঁছাইয়াছে। কোদালকে কোদাল বলাই বিধেয়— পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দল হিসাবে আপাতত একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য দলটির নাম ভারতীয় জনতা পার্টি। কেন এমন ঘটিল, তাহা ভাবিতে গিয়া বিজেপি-বিরোধী দলগুলি সৎ আত্মসমীক্ষায় বসিতে পারে। বিশেষত, বাম দলগুলি। বামের ভোট রামে গিয়াছে— কথাটি বহুশ্রুত। প্রাথমিক হিসাবও তাহাই বলিতেছে। প্রশ্ন হইল, কেন? দৃশ্যত, উগ্র হিন্দুত্ববাদী, ক্ষুদ্র, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী রাজনীতিতে বঙ্গবাসীর এবং, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভূতপূর্ব বাম ভোটারদের আপত্তি নাই! বামফ্রন্টের ভোটব্যাঙ্কের ক্ষয় ও বিজেপির স্ফীতির হিসাবটি পাশাপাশি ফেলিলেই ইহা বুঝিয়া লওয়া যায়। বাম দলগুলির প্রাপ্ত ভোটের হার আনুমানিক ৭ শতাংশে ঠেকিয়াছে, আসনসংখ্যা শূন্য। তাঁহারা কি এই শেষলগ্নে এক বার সৎ আত্মসমীক্ষা করিবেন? না কি, অন্তঃসারশূন্য অহঙ্কারের ব্যাধি যবনিকাপতন অবধি মজ্জাগতই থাকিবে? যাক প্রাণ থাক ভান?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy