কানে তুলা, পিঠে কুলার সহিত চোখেও কাপড় বাঁধিয়াছে রাজ্য সরকার। নচেৎ ডেঙ্গির প্রকোপ টের পাইতে এত বিলম্ব হইবার কথা নয়। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অন্তত কুড়ি জনের প্রাণ কাড়িয়াছে জ্বর। তাহার লক্ষণগুলির সহিত ডেঙ্গির অতিশয় সাদৃশ্য। বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসক অথবা পরীক্ষাগার রোগটিকে ‘ডেঙ্গি’ বলিয়া চিহ্নিতও করিয়াছে। কিন্তু সরকারি কর্তারা তাহা মানিতে নারাজ। ডেঙ্গি সংক্রমণকে মৃত্যুর কারণ বলিয়া উল্লেখ করিবার ‘অপরাধ’-এ চিকিৎসকদের তলব করিতেছেন পুরকর্তা, স্বাস্থ্যকর্তারা। ইহা কি চাপ সৃষ্টির কৌশল নহে? তথ্য গোপন করিয়া সত্যকে ঢাকিবার সরকারি প্রচেষ্টা দেখিবার তিক্ত অভিজ্ঞতা হইয়াছিল গত বৎসর। এই বৎসর সেই কুনাট্যের পুনরভিনয় চলিতেছে। ২০১৮ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কত, স্বাস্থ্য দফতরের নিকট সে তথ্য নাই। এই কথা স্বীকার করিয়াছেন স্বয়ং স্বাস্থ্য অধিকর্তা। অথচ তাঁহার দাবি, এই বৎসর ডেঙ্গির প্রকোপ গত বৎসরের তুলনায় কম। তথ্য-পরিসংখ্যান না থাকিলে এই বিচার কী প্রকারে সম্ভব? যখন ডেঙ্গির মোকাবিলায় অবিলম্বে জেলা হাসপাতালগুলিতে রক্তপরীক্ষার সরঞ্জাম, ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সরবরাহ, চিকিৎসার রূপরেখা পৌঁছানো প্রয়োজন, তখন ডেঙ্গি-মৃত্যুর প্রমাণ দাবি করিয়া অযথা কালক্ষেপ করা হইতেছে।
রাজ্যে যে ডেঙ্গি ছড়াইতেছে, ইহা কি অবিশ্বাস্য? রাজ্য সরকারই এই বৎসর মার্চ মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াছিল। ‘স্টেট ভেক্টর বোর্ন ডিজ়িজ়েস কন্ট্রোল অ্যান্ড সিজ়নাল ইনফ্লুয়েঞ্জা প্ল্যান, ২০১৮’ নামে ওই পুস্তিকার তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে রাজ্যে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হইয়াছিলেন প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার মানুষ। অতএব চলতি বৎসরে ডেঙ্গি ছড়াইতে পারে, তাহা মানিতে এত বিশদ তথ্যপ্রমাণ ইত্যাদির প্রয়োজন কী? বরং প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় তৎপর হওয়া প্রয়োজন। গত বৎসর অক্টোবর মাস হইতে কেন্দ্রের নিকট সংক্রমণের সংখ্যা পাঠায় নাই রাজ্য। মশাবাহিত রোগের প্রকোপ সাধারণত অক্টোবর মাসে প্রবল হয়, ডিসেম্বর অবধি তাহার রেশ চলিতে থাকে। এই বৎসর তাহার পূর্বেই ডেঙ্গি করাল রূপ লইয়াছে। কেবল কলিকাতা পুরসভা এলাকাতেই নয় শত জন আক্রান্ত মিলিয়াছে। উত্তর ২৪ পরগনা, আলিপুরদুয়ার, পুরুলিয়া, হাওড়া-সহ নানা জেলায় ডেঙ্গিতে মৃত্যুর অভিযোগ উঠিয়াছে। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে দুইটি মৃত্যুর কারণ যে ডেঙ্গি, তাহা স্বাস্থ্য দফতরও মানিতে বাধ্য হইয়াছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের তবুও দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কিসের নিয়ন্ত্রণ তাঁহারা করিয়াছেন, তাহার ইঙ্গিত অবশ্য মিলে নাই।
তথ্য গোপনের চেষ্টা রাজ্যবাসীকে বিপন্নতর করিয়াছে, তাহা গত বৎসরই প্রমাণিত। অথচ এই বৎসর ফের সেই ভয়ানক নীতিই অনুসৃত হইতেছে। ইহাতে কাহার লাভ? রোগের তীব্রতা অনুসারে কেন্দ্র অনুদান দিয়া থাকে, তাহা হারাইল রাজ্য। পরীক্ষা ও চিকিৎসায় বিলম্বের জন্য প্রাণ হারাইতেছে রোগী। তথ্য লুকাইয়া মুখরক্ষার তাগিদ তাহাতেও কমে নাই সম্ভবত এই কারণে যে, তাহাতে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা প্রকাশ হইয়া পড়ে। মশা মারিবার জন্য এই বৎসর বহু ব্যয় করিয়াছে রাজ্য সরকার। প্রতিটি পুরসভার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্মীর দল মশার কীট মারিতে নিযুক্ত হইয়াছে। কাউন্সিলররা স্বয়ং বাড়ি বাড়ি গিয়া মশা তাড়াইবার আবেদন করিবেন, এমনও প্রত্যাশা ছিল। তাহাতে কাজ হয় নাই, জঞ্জালের স্তূপ এবং বদ্ধ নিকাশি যথারীতি মশার আঁতুড়ঘরের কাজ করিয়াছে। আবারও স্পষ্ট হইল, সার্বিক পরিচ্ছন্নতা না থাকিলে কোনও একটি সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। ডেঙ্গি প্রতিরোধ লইয়া প্রচার যত হইয়াছে, কাজ তত হয় নাই। মিথ্যার সহিত মৃত্যুর সম্পর্ক এমনই নিবিড়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy