Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ব্রাজ়িল

সবার জন্য স্বাস্থ্য মানেই সবার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা ভাবলে মুশকিল, গত কাল আলোচনা করেছি। (‘গরিবের চিকিৎসা মানেই বিমা?’, ১৫-১) অন্য দেশের কিছু উদাহরণ আজ আলোচনা করতে চাই।

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৮
Share: Save:

সবার জন্য স্বাস্থ্য মানেই সবার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা ভাবলে মুশকিল, গত কাল আলোচনা করেছি। (‘গরিবের চিকিৎসা মানেই বিমা?’, ১৫-১) অন্য দেশের কিছু উদাহরণ আজ আলোচনা করতে চাই। যেমন তাইল্যান্ড। সে দেশের সরকার ২০০২ সালে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার একটা ‘প্যাকেজ’ তৈরি করে। হার্ট অপারেশন বা ডায়ালিসিস থেকে মামুলি জ্বর, পেট খারাপ, ডায়াবিটিসের জন্যে নিয়মিত ওষুধ, সবই ছিল তাতে। প্রতিটি জেলার জনসংখ্যা, আর রোগব্যাধির প্রকোপ বিবেচনা করে প্রথমে একটা বার্ষিক বরাদ্দ নির্দিষ্ট করল সরকার। জেলা আধিকারিকরা হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলির সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের বার্ষিক চুক্তি করলেন। পরের বছর বহির্বিভাগে রোগ ও চিকিৎসার বাস্তব খরচের হিসেব দিয়ে টাকার অঙ্কে কিছুটা পরিবর্তন করার সুযোগ পেল হাসপাতালগুলি। আধিকারিকরা দেখলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা চিকিৎসার ব্যবস্থা, চিকিৎসার গুণমান সম্বন্ধে রোগীদের বক্তব্য ইত্যাদি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জন্য টাকা বরাদ্দের বিষয়টা আলাদা করা হল।

তাইল্যান্ডে কিন্তু কখনওই বেসরকারি চিকিৎসা এ দেশের মতো এত ছড়ায়নি। সচেতন ভাবেই সরকার নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। শুধুমাত্র বিমা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, সে দেশের সরকার অনেক দিন ধরেই নজর দিয়েছে বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে মজবুত করার দিকে। সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে সমস্ত সুবিধাসম্পন্ন, ঝাঁ-চকচকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে ধীরে ধীরে। অযথা ডাক্তারের অভাব নিয়ে হাহাকার না করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্যারামেডিক্যাল সহায়কদের। প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রদের জন্যে ডাক্তারি-নার্সিং পড়বার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শর্ত এই যে, এদের ফিরে যেতে হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকাতেই।

মেক্সিকোর ‘সেগুরো পপুলার’ কার্যক্রমে জোর দেওয়া হয়েছিল পিছিয়ে-পড়া এলাকার সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র মজবুত করার দিকে, যাতে বেসরকারি ডাক্তারদের ওপর নির্ভরতা কমে। তাইল্যান্ডের মতো মেক্সিকোতেও মোটামুটি সব ধরনের অসুখের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-প্যাকেজ তৈরি হয়েছে। একটি এলাকার বাসিন্দারা কেবল নিজের এলাকারই কিছু নির্দিষ্ট ক্লিনিকে নিখরচায় চিকিৎসা পেতে পারেন, যে কোনও এলাকায় নয়। এতে যেমন ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলিকে এলাকার জনসংখ্যার হিসেবে একটা নির্দিষ্ট বাজেট ভাগ করে দেওয়া যায়, তেমনই সমগ্র স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাটাই অনেক বেশি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ব্রাজ়িলের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও তাদের ফুটবল বিশ্বকাপের রেকর্ডের মতোই চমকপ্রদ। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর, বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুলা ঘোষণা করেন সমস্ত মানুষের নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারের কথা। মাঝারি আয়ের দেশগুলির মধ্যে সম্ভবত ব্রাজ়িলেই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। প্রতিটি এলাকার জন্যে নির্দিষ্ট সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত ওষুধ, জরুরি পরীক্ষাও মেলে। ‘প্রোগ্রামা সাউদা দ্যা ফামেলিয়া’ বা পরিবার স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অধীনে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি দল প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট এলাকার প্রতি বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেন, দরকারে চিকিৎসাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এতে ফলও মিলছে। এই কর্মসূচির জন্যে ব্রাজ়িলে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

লক্ষণীয় ভাবে কমেছে শিশুমৃত্যুর হার। নিয়মিত চিকিৎসা ও মন্দ অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের ফলে হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপের জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রবণতা কমেছে।

ভারতের সঙ্গে তুলনা চলে, এমন অনেক দেশ গোড়াতেই স্বাস্থ্যবিমা বেছে নেয়নি। সরকারের হাতে মূল নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। নেহাত প্রয়োজন হলে, অনেক হিসেবনিকেশ করে বেসরকারি চিকিৎসাকে জোড়া হয়েছে। চুক্তি হয়েছে সরকারি কোষাগারের কথা মাথায় রেখে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রতিযোগী হিসেবে মজবুত না করে তুলে কেবলমাত্র বিমার উপরে নির্ভর করলে তাতে যে আখেরে বেসরকারি চিকিৎসা-ব্যবসাই ফুলে-ফেঁপে উঠবে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

এখানেই আসে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। নির্বাচনের আগে প্রকল্পের গালভরা নাম দিয়ে, চটজলদি কিছু চমক সৃষ্টি করাই যায়। একটা বড়সড় টাকার অঙ্কের চিকিৎসা মিলবে, এ কথা বললে মানুষ খুশিই হবে। কিন্তু চিকিৎসার উন্নতি, দীর্ঘমেয়াদি অসুখের চিকিৎসা বা নিত্যনতুন জীবাণুবাহিত রোগের প্রকোপ কমানোর ব্যবস্থা না করে কেবল বিমার উপরেই ভরসা করলে লাভ হবে না। হাসপাতালে ভর্তি বা ‘ইনডোর’ চিকিৎসা, আর বাইরের ‘আউটডোর’ চিকিৎসাকে আলাদা করে না দেখে, সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখা দরকার। স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে সদর্থক রাজনীতি হোক এ বারে। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Insurance Hospital Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE