Advertisement
E-Paper

উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ফিরে দেখা

এক কালে চা-বাগানেই মিলত চিকিৎসা পরিষেবা এবং ওযুধ, করা হত ছোটখাটো শল্য চিকিৎসাও। সে ছবি এখন আমূল বদলে গিয়েছে। লিখছেন অমিতকুমার দেউনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে তিস্তা থেকে সঙ্কোশ পর্যন্ত বিস্তৃত যে ভূখণ্ডের নাম হয় ডুয়ারস।

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:৩৫
চা-বাগানের ইউরোপীয় মালিকরা নজর দিয়েছিলেন চিকিৎসা পরিষেবার দিকে।

চা-বাগানের ইউরোপীয় মালিকরা নজর দিয়েছিলেন চিকিৎসা পরিষেবার দিকে।

ডুয়ারসের সবুজ ছুঁয়ে ভুটান পাহাড়ের দিকে দিকে যেতে যেতে আকস্মিক চোখ চলে গেল বন্ধ ঘরগুলোর দিকে। বোঝা যাচ্ছে, প্রায়-পরিত্যক্ত ঘর। অথচ, অতীতের যত্নের ছাপ এখনও গায়ে লেগে আছে। বাইক থামিয়ে নেমে স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলাম, এখানে কী হয়। জানা গেল, এটি চা-বাগানের হাসপাতাল। আগে চালু ছিল, এখন বন্ধ। মনে প্রশ্ন জাগল, চা-বাগানের মানুষদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আগে কেমন ছিল আর এখন কেমন? বিশেষত, বন্ধ ও রুগ্‌ণ বাগানে? উত্তরের খোঁজে চলে গেলাম চা-বাগান বিশেষজ্ঞ ব্রজগোপাল ঘোষ এবং অারও কয়েকজনের কাছে।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে তিস্তা থেকে সঙ্কোশ পর্যন্ত বিস্তৃত যে ভূখণ্ডের নাম হয় ডুয়ারস। এক সময় যে ভূখণ্ডকে ‘আনপ্রোডাক্টিভ’ ভেবে ভুটানকে উপঢৌকন দিয়ে দিয়েছিল সরকার, সেখানে চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮৭৪ সালে। যতই দৃষ্টিনন্দন হোক চার দিক, এই বাগিচা অঞ্চলে জাঁকিয়ে বসেছিল ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর আর ডেঙ্গু। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলে কিছুই ছিল না। তাই উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু আর মৃত্যুভয় এসে জমাট বেঁধেছিল এখানে।

চা-বাগানের ইউরোপীয় মালিকরা নজর দিয়েছিলেন চিকিৎসা পরিষেবার দিকে। বাগান গড়ে উঠলে তার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালও গড়ে উঠল। সেখানে নিযুক্ত হলেন লাইসেন্সড মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি (এলএমএফ)। জলপাইগুড়ির জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করে আসা অনেকেই চা-বাগানের হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে গেলেন। স্টেথোস্কোপ না আসা পর্যন্ত সেখানে দেখা মিলত নাড়িটেপা ডাক্তারদের। অনেক শিক্ষিত বঙ্গসন্তান চা-বাগানে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন। তাঁদের বেতন আহামরি না হলেও প্রবল সম্মান ছিল। মানুষ প্রায় দেবতাজ্ঞানে দেখতেন তাঁদের।

চা-বাগিচা অঞ্চল অনেকগুলো সাবডিস্ট্রিক্টে বিভক্ত ছিল। যেমন— দলগাঁও, বিন্নাগুড়ি, নাগরাকাটা, চালসা, ডামডিম, ওদলাবাড়ি, কালচিনি ইত্যাদি। প্রতিটি সাবডিস্ট্রিক্টে একজন করে বড় ডিগ্রিধারী চিকিৎসক থাকতেন। এমআরসিপি কিংবা এফআরসিএস। তাঁরা বসতেন সেন্ট্রাল হসপিটালে। সঙ্গে থাকতেন একজন করে প্যাথোলজিস্ট। এই সেন্ট্রাল হসপিটালেই এই সব চিকিৎসকের অধীনস্ত সমস্ত বাগানের রোগীদের প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হত অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এই এমআরসিপি কিংবা এফআরসিএস চিকিৎসকেদের অনেকেই ছিলেন রয়্যাল কলেজ অব ফিজিসিয়ান/সার্জারির সদস্য। তাঁদের বলা হত ডাক্তার সাহেব। এই ডাক্তার সাহেবরা সপ্তাহে একদিন ‘রোটেশন’-ভিত্তিতে বিভিন্ন বাগানে যেতেন। তখন বাগানের ইউরোপীয় উচ্চ পদাধিকারীরা যেমন চিকিৎসা পরিষেবা এঁদের কাছ থেকে পেতেন, তেমনই চিকিৎসা পেতেন বাবু ও শ্রমিক শ্রেণিও।

চা-বাগানেই পর্যাপ্ত ওষুধপত্র মিলত। বছর শেষে ডিসেম্বর মাসেই কম্পাউন্ডার সারা বছরের ওষুধের রিকুইজিশন হেড অফিসে পাঠিয়ে দিতেন। বিরাট প্যাকিং বাক্স করে জানুয়ারি মাসেই চলে আসত সে সব ওষুধ। আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এখন ব্লক হাসপাতাল থেকেও সামান্য কারণে রোগীকে জেলা সদর বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হলেও সে সময় চা-বাগান থেকে রোগী রেফার করার ব্যাপারই ছিল না। চা-বাগানেই সব ধরনের চিকিৎসা হত। এমনকি, ছোটখাটো সার্জারিও। কোয়ার্টারে ডাকলেও ডাক্তারকে আলাদা ‘ভিজিট’ দিতে হত না। মাঝে মাঝে ক্যাম্প হত, বাচ্চাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার, মায়েদের জন্যও। কোনও শ্রমিক অসুস্থ হয়ে কাজে যেতে না পারলেও তাঁর পুরো বেতন কাটা হত না। দিনের মজুরির দুই-তৃতীয়াংশ তিনি পেতেন।

এই চিকিৎসকদের কথা বলতে গিয়ে ব্রজগোপাল ঘোষ তাঁর স্মৃতি থেকে তাঁর মায়ের চিকিৎসার কথা বলছিলেন। তাসাটি বাগানের চিকিৎসক বিভূতিভূষণ মৈত্র কী দক্ষ ভাবে হৃৎপিণ্ডের জটিল রোগে আক্রান্ত তাঁর মায়ের চিকিৎসা করতেন প্রত্যন্ত বাগানে, সেই কথা। তাঁকে মহীরুহ বলেই মনে হত তাঁর।

ছয়ের দশকে সেন্ট্রাল হসপিটাল বন্ধ হয়ে গেল। দলমোড় বাগানের ডাক্তার-কোয়ার্টার বিক্রি হয়ে গেল। অবসর নিলে ডাক্তার আর কম্পাউন্ডারের শূন্য পদে আর নিয়োগ হল না অনেক ক্ষেত্রেই। বাগান দেশীয় শিল্পপতিদের হাতে যাওয়ার পরে চিকিৎসার হাল অনেকটাই শেষ হয়ে গেল। বন্ধ হতে লাগল অনেক হাসপাতাল। ওযুধের সরবরাহ বিঘ্নিত হল।

এখন চা-বাগানের চিকিৎসা কেমন? অনেকটাই যার যার, তার তার! পর্যাপ্ত ওযুধ সব ক্ষেত্রে মেলে না। চিকিৎসক নেই অনেক বাগানেই। সেই সুযোগে হাতুড়ে-সংস্কৃতি ফের মাথা চাড়া দিয়েছে। রেফার করা রোগীকে নিয়ে অনেককেই ছুটতে হচ্ছে দীর্ঘ পথ।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Tea Garden North Bengal Health
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy