চারটি ঘণ্টা। রাজধর্ম হইতে চ্যুত হওয়ার কয়েক দশকব্যাপী দীর্ঘ ইতিহাস মুছিয়া সুশাসনে ফিরিবার জন্য চার ঘণ্টার একটি জানালা পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের সম্মুখে খুলিয়াছিল। কর্তারা তাহা হেলায় বন্ধ করিয়া দিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, দলতন্ত্রকে অতিক্রম করিয়া রাজধর্ম প্রতিষ্ঠা করিবার বাসনা তাঁহাদের নাই। আদালতের নির্দেশে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা করিবার সময়সীমা সোমবার চার ঘণ্টার জন্য বর্ধিত হইয়াছিল। গোটা মনোনয়ন পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসন যে লজ্জাকর ভঙ্গিতে চলিয়াছে, তাহাকে পাল্টাইয়া ফেলিবার সুযোগ ছিল এই চার ঘণ্টায়। আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করিবার অবকাশ ছিল। তাহাতে অতীত-পাপেরও খানিক ক্ষালন হইত। রাজ্য প্রশাসন বুঝাইয়া দিল, প্রায়শ্চিত্তে তাহাদের রুচি নাই। রাজ্যব্যাপী সন্ত্রাসের ধারা অব্যাহত। বস্তুত, সোমবার তাহা নূতন নজির স্থাপন করিল। খুন হইতে মনোনয়নপত্র লুট, বিরোধীদের বিপুল মারধর, সাংবাদিক নিগ্রহ, এবং সেই নিগ্রহের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও বহু স্থানে এক জনকেও গ্রেফতার না করা— ৩৪ বৎসরের বাম শাসন, এমনকী তৃণমূলের রাজত্বের তুলনাতেও এই প্রতিকারহীন হিংস্রতা অভূতপূর্ব। গোটা রাজ্য জুড়িয়া দুষ্কৃতীরা যখন দাপাইয়া বেড়াইতেছে, পুলিশ কোথায়? নির্বাচন কমিশনের কর্তারাই বা কোথায়? দৃশ্যত, প্রশাসন সমগ্র নির্বাচনপ্রক্রিয়াটিকে দুষ্কৃতীদের হাতে ছাড়িয়া দিয়াছে। যে পুলিশ শাসকদলের বাহুবলীদের ভয়ে থানাতেই টেবিলের তলায় লুকাইয়া পড়ে, শাসকদলের কেষ্ট-বিষ্টুরা যে পুলিশকর্তাদের যথেচ্ছ ধমকান, সেই পুলিশের নিকট উর্দির মর্যাদারক্ষা অপেক্ষা জরুরিতর কাজ আছে বলিয়াই অনুমান করা চলে। তাঁহারা সেই জরুরি কাজ করিয়াছেন।
রাজ্য হইতে রাজধর্ম কবে বিদায় লইয়াছে, সেই তারিখ খুঁজিতে বসিলে ২০১১ সাল ছাড়িয়া আরও অনেক পিছাইতে হইবে। বর্তমান শাসকরা সেই ঐতিহ্যটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছেন। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা সেই দলীয় দায় বহন করিয়াই চলিবেন? চাকুরির শর্ত হিসাবে তাঁহারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অধীন। কিন্তু, মন্ত্রী-বিধায়কদের সংবিধানবিরোধী নির্দেশ মানিবার কোনও দায় তাঁহাদের নাই। শাসক দলের স্বার্থরক্ষার দায়ও নহে। কী ভাবে নেতা-মন্ত্রীদের অন্যায় আবদার ঠেকাইতে হয়, এক কালে আমলা-পুলিশকর্তাদের তাহা অবশ্যশিক্ষণীয় ছিল। এখন আমলারা জনান্তিকে বলেন: আপনারা যাহা দেখিতেছেন, আমরাও তাহাই দেখিতেছি! শুধু দেখাতেই যে তাঁহাদের কাজ ফুরাইয়া যায় না, দৃশ্যটির সংশোধনের দায়িত্বও তাঁহাদেরই, আমলারা এই কথাটি প্রাণপণে ভুলিয়াছেন। তাঁহারা জানেন, হীরকের রাজা ভগবান। তাহার অধিক জানিলে, বুঝিলে রাজরোষে পড়িতে হয়। সেই ধকল তাঁহাদের সহিবে না।
শাসক দলের নেতাদের তবু বলিবার উপায় আছে যে রাজ্যে যাহা চলিতেছে, সবই বিরোধীদের গোষ্ঠীকোন্দল। বিরোধীরা কেন সর্ব ক্ষণ নিজেদের মধ্যেই কোন্দল করিয়া চলিতেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর চাহিলে তাঁহারা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বা মুরলীধর সেন লেনের ঠিকানা ধরাইয়া দিতে পারেন। প্রশাসনের সেই অজুহাতটুকুও নাই। শাসক দলের আশ্রিত গুন্ডারাই সন্ত্রাস করুক বা বিরোধী পোষিত বাহুবলীরা, যে কোনও হিংস্রতা দমন করিবার দায়িত্ব প্রশাসনের। অভিযোগ, রাজ্যের যে প্রান্তে যে দল শক্তিশালী, সেখানে তাহারা চড়াও হইতেছে। প্রশাসন সর্বত্রই দর্শক। ইহা হওয়ারই ছিল। নত হওয়ার যে প্রশিক্ষণ পুলিশ-প্রশাসনের মজ্জায় মিশিয়াছে, তাহাকে ভোলা দুষ্কর। যেখানে যে দল শক্তিশালী, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের নিকট সেখানে তাহারাই মান্য। আদালতের দেওয়া চারটি ঘণ্টা অতএব জলে গেল। অথবা, রক্তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy