Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আওরঙ্গজেব মন্দির না ভাঙলে বিশ্বনাথ প্রধান দেবতা হতেন কি?

নৌকো থেকে ঘাটের সিঁড়ি, মন্দিরের চাতাল, সর্বত্র লোকারণ্য, মুহুর্মুহু ঝলসাচ্ছে মোবাইল-ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। সন্ধ্যার এই গঙ্গা-আরতিই বারাণসীর নতুন রিচুয়াল।

গঙ্গারতি: বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে নতুন প্রথা। মির রুস্তম আলি এই ঘাটেই ভূর্বমঙ্গল উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছবি: সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।

গঙ্গারতি: বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে নতুন প্রথা। মির রুস্তম আলি এই ঘাটেই ভূর্বমঙ্গল উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ছবি: সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০৯
Share: Save:

স ন্ধ্যাবেলায় দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে আরতি দেখছিলাম। মাইকে গঙ্গাস্তোত্র, পাঁচ পুরোহিত পিতলের বড় বড় প্রদীপ ঘুরিয়ে একযোগে শঙ্খধ্বনিতে আরতি করছেন। নৌকো থেকে ঘাটের সিঁড়ি, মন্দিরের চাতাল, সর্বত্র লোকারণ্য, মুহুর্মুহু ঝলসাচ্ছে মোবাইল-ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। সন্ধ্যার এই গঙ্গা-আরতিই বারাণসীর নতুন রিচুয়াল।

সত্তরের দশকে মা-বাবার সঙ্গে যখন বেড়াতে আসতাম, এই গঙ্গারতি দেখিনি। হরিদ্বারের আদলে পুজো-পদ্ধতিটি দশাশ্বমেধ ঘাটে শুরু হয় ১৯৯১ সালে। তার পর এখন অসিঘাট, অন্যত্রও। হিন্দুর পবিত্র শহরটি দশকে দশকে বদলে যায়। এই বদলে-যাওয়া শহরের প্রথম ভিত ছিল কসমোপলিটান এক মুঘল শহর। তখন র‌্যালফ ফিঞ্চ থেকে বার্নিয়ের, তাভার্নিয়ে, সব বিদেশি পর্যটক কাশী যান, ঘাটে ঘাটে পুণ্যার্থীদের স্নান থেকে মন্দিরের কথা অনেক লিখে গিয়েছেন তাঁরা। আজকের কাশীতে প্রতি পদে যে বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড়, সেটি মুঘল ঐতিহ্য!

সন্ধ্যারতির দশাশ্বমেধ ঘাট যেমন! শুধু পিতামহ ব্রহ্মার দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের মিথ-স্মৃতি নয়। মুঘল আমলে ভট্টোজি দীক্ষিত নামে এক মরাঠি ব্রাহ্মণ স্মৃতিগ্রন্থে জানিয়েছিলেন, দশাশ্বমেধ এবং পঞ্চগঙ্গাই কাশীর প্রধান পুণ্যঘাট। ১৭৩৫ সালে মরাঠা পেশোয়াকে তাঁর কাশীর প্রতিনিধি চিঠি লিখছেন, ‘পেশোয়ার নির্দেশিত প্রাসাদটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইট, সুরকি ও ইমারতি জিনিস শহরে মিলছে না।’ অওধের নবাবের প্রতিনিধি মির রুস্তম আলি তখন দশাশ্বমেধ ঘাটে নিজস্ব মহল তৈরি করছেন। মির রুস্তম আলির সেই প্রাসাদ আর নেই। পরে বারাণসীর রাজা চৈৎ সিংহ যখন ঘাটে তাঁর প্রাসাদ তৈরি করেন, মির রুস্তম আলির মহল কিনে সেখান থেকে ইট-সুরকি ব্যবহার করেন। আজ দশাশ্বমেধ ঘাটে জাঁকজমকের যে সন্ধ্যারতি, তার পিছনেও মির রুস্তম আলি! গণেশপুজোর সময় তাঁর উদ্যোগে গঙ্গায় ভূর্বমঙ্গল নামে একটি উৎসব হত, রকমারি বজরায় আর ইলাহি নাচগানে নদী ভেসে যেত। কাশী এ রকমই! মুসলমান শাসক গঙ্গায় উৎসব করবেন, হিন্দু রাজা ছোঁয়াছুঁয়ির বালাই না রেখে মুসলিম প্রাসাদ কিনে নেবেন।

আরতি দেখার আগে সকালে গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ মন্দির। সেই পরিচিত দৃশ্য। পাশে জ্ঞানবাপী মসজিদ, মেটাল ডিটেক্টর আর কম্যান্ডো-পাহারা। আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরিতে লিখছেন, কাশীতে প্রধান দর্শনীয় একটি শিবলিঙ্গ। মুসলমানেরা যেমন কাবার চার দিকে পরিভ্রমণ করে, হিন্দুরাও এখানে সে রকম করে। আবুল ফজল এটিকে ‘বারাণসী পুজোপদ্ধতি’ বলছেন।

এখন বারাণসী রীতিতে যাওয়ার উপায় নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে মন্দিরের এক দরজা দিয়ে ঢুকে, বিশ্বনাথকে ফুল, বেলপাতা চড়িয়ে উলটো দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। কাশীতে হিন্দুর পুজোপদ্ধতির প্রথম খুঁটিনাটি লিখে গিয়েছেন আকবরের সভাসদ!

আবুল ফজল অবশ্য বিশেষ কোনও মন্দির বা লিঙ্গের নাম লেখেননি, ওঙ্কারেশ্বর, মহাকালেশ্বর তখন কাশীর প্রধান শিবলিঙ্গ। শহরের উত্তরে, মচ্ছোদরী পার্ক ছাড়িয়ে মুসলিম মহল্লায় ওঙ্কারেশ্বর মন্দির আজ নিঃসঙ্গ। পাশেই কবরখানা। বাবরি মসজিদ ঘটনার পরেও এই মন্দিরে আঁচড়টি পড়েনি।

আকবর, জাহাঙ্গিরের মুঘল আমলে কাশীতে তখন শৈব, বৈষ্ণব, গাণপত্য সব সুতোই একত্র। বৈষ্ণবদের প্রধান দেবতা বিন্দুমাধব এবং শৈবদের বিশ্বনাথ। বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটে, ত্রৈলঙ্গস্বামীর মঠ থেকে একটু এগিয়েই বিন্দুমাধব। তার পাশে ধারারা মসজিদ। বিন্দুমাধবের প্রাচীন মন্দির ভেঙে আওরঙ্গজেব এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। মানে, বিশ্বেশ্বরের ওপর আওরঙ্গজেবের কোনও জাতক্রোধ ছিল না। শৈব বিশ্বনাথ ও বৈষ্ণব বিন্দুমাধব, দুটিকেই তিনি ধ্বংস করেন। সব ক’টা মন্দির নির্বিচারে শেষ করা তাঁর ব্রত ছিলও না। ভারতকলাভবনের লেখ্যাগারে এখনও আছে তাঁর ১৬৫৮ সালের এক ফরমান: বারাণসীর মন্দির ও পুরোহিতদের রক্ষা করবেন মুঘল শাসক। বাদশাহি ফরমান দেখার ধৈর্য যাঁদের নেই, অক্লেশে চলে আসতে পারেন কেদারঘাটে। এখানেই কেদারেশ্বরের মন্দির, কাশীতে থাকার সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণ প্রায়ই মথুরবাবুর সঙ্গে নৌকোয় চড়ে আসতেন। এই কেদারেশ্বরের মন্দির সংস্কারে টাকা দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। তার পাশে আজও আছে কুমারস্বামী ও জঙ্গমবাড়ি মঠ। এগুলি তৈরিতেও আওরঙ্গজেবই অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। মন্দির যা ধ্বংস করেছিলেন তিনি, বেছেই করেছিলেন।

এই যে বেছে বেছে মন্দির ধ্বংস, তার মানচিত্রটা জানা জরুরি। তখন মণিকর্ণিকা, দশাশ্বমেধ, পঞ্চগঙ্গা, এগুলিই প্রধান ঘাট। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মাধুরী দেশাই তাঁর সদ্য-প্রকাশিত ‘বেনারস রিকনস্ট্রাক্টেড’ বইয়ে দেখিয়েছেন, এখানকার অধিকাংশ জমিই তখন মানসিংহ ও তোডরমলের বংশধরদের আওতায়। মূল রাস্তাটা ছিল মণিকর্ণিকার ঘাট, মন্দির হয়ে পঞ্চগঙ্গা। সেখান থেকে শহরের বাইরে যাওয়ার প্রধান সড়ক, আওরঙ্গজেব তৈরি করবেন সরাইখানা। এখনও আছে আওরঙ্গাসরাই। বাঙালির চেনা গোধূলিয়া মোড় তার অনেক পরে, ইংরেজ আমলের কথা।

আওরঙ্গজেব-ই ১৬৬৯ সালে বারাণসীর প্রধান দুটো মন্দির ধ্বংস করেন। বিশ্বনাথ চত্বরের অন্য মন্দির, ব্রাহ্মণদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হল না। মণিকর্ণিকার শ্মশান, মন্দিরের রাস্তায় ‘চওক’ বা বাজার এলাকাতেও হাত দিলেন না তিনি। ভিত্তিপ্রস্তর বা ‘প্লিন্থ’ পুরো ধ্বংস করা হল না, সেখান থেকে ইট নিয়ে আসা হল জ্ঞানবাপী মসজিদে। প্রায় সার্জিকাল অপারেশন! আধুনিক ইতিহাসবিদরা অনেকেই বলছেন, এই ধবংসের কারণটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নয়, বরং পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, এলাকায় কোনও মতবিরোধিতা ঘটেছিল, সম্রাট সহ্য করেননি। দুই, আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পুজোপদ্ধতি যেন আলাদা, দাঁড়ি-টানা এলাকায় থাকে। কেদারেশ্বর অনেকটা দক্ষিণে, ফলে তরবারির আঘাত সেখানে পড়েনি।

এই বিশ্বনাথও মুঘল ঐতিহ্য। ১৫৯০ সালে নারায়ণ ভট্ট ও তোডরমলের অর্থসাহায্যে যখন বিশ্বনাথ মন্দির তৈরি হয়, তার চাতালে ‘কামসম্বন্ধ’ নামে একটি বৈষ্ণব ভাবসমৃদ্ধ নাটক অভিনীত হয়। মানে, বিশ্বনাথ তখনও শহরের প্রধান দেবতা হননি, বৈষ্ণব পরম্পরা ছিল। জাহাঙ্গিরের বন্ধু রাজা বীরসিংহ বুন্দেলা এই নতুন শিবমন্দিরের একটি শিখর সোনায় মুড়ে দেন। আওরঙ্গজেবকে গালি দেওয়ার আগে, মুঘল মানে মুসলমান এবং মন্দির ধ্বংসকারী— এই সহজ সমীকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

মুঘলরা কী রকম? কাশীর পণ্ডিত কবীন্দ্রাচার্য তখন সম্রাট শাহজাহানকে সটান বলছেন, জিজিয়া করটা তুলে দিন। গর্দান গেল না, উলটে কবীন্দ্রাচার্য হয়ে গেলেন শাহজাদা দারাশিকোর শিক্ষক। আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে দিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর পৌত্র মহম্মদ শাহ তখন মাঝে মাঝে শিবালা ঘাটে এসে থাকেন। মন্দির ধ্বংসের পরই নাগরিক পরিসরে শূন্য স্থানটির গুরুত্ব বেড়ে গেল।

শূন্য কখনও শূন্য থাকে না। মুঘল আমলের শেষ দিকে হরেক কথা উঠল। কোথায় ছিলেন বিশ্বনাথ, কেমন ছিল তাঁর চত্বর? মুঘলরা দুর্বল, কাশীতে তখন ক্ষমতা নিচ্ছে নানা আঞ্চলিক শক্তি। জয়পুরের রাজারা বলছেন, মসজিদের কাছ থেকে অন্য জায়গায় মন্দির সরাতে হবে। ইনদওরের মাধবরাও হোলকার বললেন, পুরো মসজিদটাই ভেঙে দাও। ভাঙার দরকার হয়নি, জ্ঞানবাপী মসজিদের পাশেই জায়গা পেলেন তাঁরা। ১৭৮১ সালে মাধবরাওয়ের বিধবা পুত্রবধূ অহল্যাবাই হোলকার এখানেই তৈরি করলেন নতুন বিশ্বনাথ মন্দির।

কিন্তু তার আগে একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে। পেশোয়াদের অন্যতম দেবী অন্নপূর্ণা। মাধবরাওয়ের সময়ে তৈরি হল তাঁর মন্দির, পরে অহল্যাবাইয়ের নতুন মন্দিরের চত্বরে সংযুক্ত হল সেটি। আওরঙ্গজেব মন্দির না ভাঙলে বিশ্বনাথ প্রধান দেবতা হতেন না। দেবী অন্নপূর্ণাও অধিষ্ঠান করতেন না।

পুজোপদ্ধতির বদল বোঝা যায় জ্ঞানবাপী মসজিদে। উনিশ শতকে বাঙালি জয়নারায়ণ ঘোষাল কাশীতে যাচ্ছেন। তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিতে প্রণাম করছেন। আজকের কম্যান্ডোবেষ্টিত চত্বরে সেই পদ্ধতি, অবশ্যই আর নেই।

কাশী বুঝিয়ে দেয়, পুজোপদ্ধতি প্রাচীনত্বে থিতু কোনও জরদ্গব বিষয় নয়। হিন্দু এবং ইসলাম দুটো সুতোই পাশাপাশি থাকতে থাকতে একে অপরের উপর প্রভাব ফেলে, সেই প্রভাবে নিজেরা বদলে যায়। আর ওই বদলের মধ্য দিয়েই পুজোপদ্ধতি খুঁজে নেয় নিজস্ব পথ। গোলওয়ালকরের শিষ্যদের এটা বোঝার কথা নয়, কিন্তু সেকুলাররাও অপরাধী। তাঁরা সম্প্রীতির গোলা গোলা কথা বলে কর্তব্য সমাপন করেন। পুজো-অর্চনা ও পবিত্রতার ধারণা কী ভাবে বদলে যায়, সে আলোচনায় সভয় বিরত থাকেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE