ইট ভাটায় কর্মরত শ্রমিক। ফাইল চিত্র
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই কর্ম বিভাজন শুরু হল। এক শ্রেণি কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও অপর শ্রেণি ভূস্বামী বা জমির মালিক। ধীরে ধীরে সমাজে তৈরি হয়ে গেল শ্রেণি বৈষম্য। কিছু সুবিধাভোগী মানুষ এটা বেশ বুঝে গেলেন, বিনা পরিশ্রমে কেবল বুদ্ধি খাটিয়ে অপরের শ্রমের উপরে নির্ভর করে দিব্যি সুখে থাকা যায়। এই ধারণা থেকেই পরবর্তী কালে বিশেষত প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় দাসপ্রথা গড়ে উঠেছিল।
ক্রমশ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে উন্নত ও পরে স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে কলকারখানা গড়ে উঠল। সেই সব জায়গায় রুটিরুজির জন্য বহু শ্রমিক নিয়োজিত হলেন। বহু দশক জুড়ে এ ধরনের শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমদিবস ছিল না। মালিকের প্রয়োজন অনুযায়ী, তাঁদের কাজ করতে হত। দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় পারিশ্রমিক ছিল নগণ্য। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে এ ধরনের শ্রমজীবী মানুষেরা প্রাণের দায়ে ক্রমশ একত্রিত হতে থাকলেন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে ধীরে ধীরে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন বাড়তে থাকল। আমেরিকায় শ্রমিকদের মধ্যে থেকে গড়ে উঠল সমাজবাদী, বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন, ক্লাব ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উত্তর গোলার্ধে মে মাসের প্রথম দিবসটি উদ্যাপিত হত ‘বসন্ত আবাহন দিবস’ উপলক্ষে। যার মধ্যে এই ব্যঞ্জনা নিহিত ছিল যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন তীব্র শীতের অবসানে একটু উষ্ণতার উৎসব। বিশেষত, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষদের কাছে বসন্তের আগমন ছিল ঈশ্বরের আগমনের মতো। যাঁরা প্রাসাদ বা দুর্গে বসবাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং নিতান্ত কুটিরে বসবাস করতেন, এটা ছিল তাঁদের কাছে এক পরম পাওয়া।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
পক্ষান্তরে দক্ষিণ গোলার্ধে এর বিপরীত অর্থাৎ, গ্রীষ্মের অবসানে শীতের আবাহন হিসেবে ‘মে দিবস’ পালিত হতো। কিন্তু মে দিবস একটি রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হল বিশেষত, আমেরিকার সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষের কাছে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে যে দিন শ্রমিকেরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে মহামিছিল সংগঠিত করেছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে। দাবি ছিল, শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও বাকি আট ঘণ্টা খেলাধুলোর সুযোগ করে দেওয়া। এই দাবি স্বাভাবিক ভাবেই পুঁজিপতিদের আঘাত করল। যাঁরা এতকাল শ্রমিকদের সব
রকমের চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে এসেছিলেন।
প্রতিটি বিপ্লবেরই প্রতি-বিপ্লব থাকে। সুতরাং, ওই নিরীহ মিছিলের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ নেমে আসে। পুঁজিপতি শ্রেণি স্থির করেছিল যে ভাবে হোক এই শ্রমিক নেতাদের দমন করতেই হবে, যাতে গণশ্রম আন্দোলন ফের মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ফলস্বরূপ, ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে শুরু হওয়া শ্রমিক ধর্মঘটে সামিল হন। তার প্রতিক্রিয়ায় নিরস্ত্র মানুষের উপরে গুলি চালানো হয়। পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদের কয়েক জন মারা যান। বহু শ্রমিক আহত হন। অনেক শ্রমিক কারাবরণ করেন এবং পরের বছর শিকাগোর এক শ্রমিক নেতার ফাঁসি হয়। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১ মে ফের আমেরিকায় দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘট আহূত হয়। সেই থেকে প্রায় পৃথিবী ব্যাপী ‘মে দিবস’কে শ্রমদিবস হিসেবে পালনের রীতির সূত্রপাত। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ‘মে দিবস’কে শ্রম দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতবর্ষে চেন্নাই শহরের মেরিনা বিচে ১৯২৩ সালে প্রথম ‘মে দিবস’ পালিত হয়।
বর্তমানে ‘মে দিবস’ আরও পাঁচটা প্রচলিত উৎসবের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষদের আর্থিক ও অন্য সহায়তা দানের কাজ বহু দিন আগেই করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবিভক্ত বাংলার শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনার ফাঁকে তিনি গ্রামের দুঃস্থ, অসহায়, খেতমজুর, শ্রমজীবী মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে বহু সামাজিক কাজ করেছিলেন। দরিদ্র মানুষের জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক, কৃষিঋণের ব্যবস্থা, সামান্য খরচে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার উদ্দেশে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাম্প্রতিক কালে সেই কাজের ধারাকে ‘বীজমন্ত্র’ হিসেবে গ্রহণ করে ‘মাইক্রোফিনান্স’ চালু করে অধুনা বাংলাদেশে এক ব্যাপক কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলেছিলেন মহম্মদ ইউনুস, যার ফলস্বরূপ তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
শ্রেণিহীন সমাজের কথা কেবল বামপন্থীরা বলেছেন এমনটা নয়। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে শ্রীচৈতন্য ধর্মীয় ভাব আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্যবাদের প্রচার করে গিয়েছেন। রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের পুরোধা স্বামী বিবেকানন্দ শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ সকল প্রকার ভেদাভেদ দূর করার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ধরিত্রী কি আজও প্রকৃত সাম্য লাভ করেছে? এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু, নারী শ্রমিক, কৃষকদের কী চরম অবমাননার শিকার হতে হয়। ভারতের আনাচেকানাচে নজর ফেললেই শিশু-শ্রমিকের দেখা মেলে।
অবিভক্ত সোভিয়েত দেশে শ্রমের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও বেশি দিন সফল হয়নি। সোভিয়েত দেশগুলি খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়েছে। কাজেই জোর করে সাম্য বা অসাম্য কোনওটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রূপে ধরে রাখা সম্বভ নয়। এটাই বাস্তব। তারই মধ্যে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সামনে ধরে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ভেদাভেদ মুক্ত সমাজের কল্পনা করেন বহু মানুষ। তাই মানুষ
আজও ‘মে দিবস’ উদ্যাপনে এগিয়ে আসেন।
(বাঁকুড়া জেলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy