Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের মনের মধ্যে চিরবসন্ত, লিখলেন জয় গোস্বামী

আমাদের মফস্সল রানাঘাট শহরে যেমন প্রত্যেকটা ঋতু আলাদা আলাদা ভাবে বোঝা যেত। ষাট-সত্তর দশকে তখনও অনেক গাছপালা ছিল শহরে। পুকুর ছিল। প্রকৃতিকে অনুভব করা যেত গভীর ভাবে।প্রচুর গাছপালা ছিল তখন। আমি ষাটের দশকের কথা বলছি। বসন্তের আগমন খুব ভাল বোঝা যেত।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০১:০৭
Share: Save:

‘‘কাকে তুলে দিতে গেছি ভোরবেলার ট্রেনে?

দোলের পরের দিন। গাছে গাছে তখনও আবির।’’

রানাঘাটে তো কোনও বসন্ত উৎসব হত না। ওখানে দোল খেলা হত। আমরা সকালবেলা আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তাম আবির নিয়ে। আবির খেলা হত। তখন আমাদের বালক বয়েস। রং খেলাও চলত। কুমকুম। বেলুনের মধ্যে রং ভরে ছুড়ে মারা। পিচকিরি দিয়ে রং খেলা।

প্রচুর গাছপালা ছিল তখন। আমি ষাটের দশকের কথা বলছি। বসন্তের আগমন খুব ভাল বোঝা যেত। আমরা যে তখন বসন্ত ঋতুকে খুব ভাল বুঝতাম, তা নয়। তবে এটুকু বুঝতাম, দোল খেলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে। রোদ্দুরটা যেন আবির রঙের রোদ।

আস্তে আস্তে বড় হলাম। প্রাপ্তবয়স্ক হলাম। তখন দোলে শান্তিনিকেতন যাওয়া শুরু করলাম। প্রত্যেক বসন্ত উৎসব তখন ওখানেই। এটা নব্বইয়ের দশকের কথা বলছি। আমি, আমার স্ত্রী কাবেরী এবং আমার কন্যা বুকুন। ওখানে গিয়ে একটা বড় দল তৈরি হয়ে যেত। শান্তিনিকেতনে দোল খেলা মানেই তো আবির খেলা। সেটাই খেলতাম।

আর এখন যেখানে থাকি সেটা সল্টলেকের শ্রাবণী আবাসন। এখানে ইমানুল হক বলে এক জন ভদ্রলোক রয়েছেন। কলেজে পড়ান। তিনি প্রতি বার বসন্ত উৎসব করেন আবাসিকদের নিয়ে। আবাসিকদের বাড়িতে যাঁরা আসেন, তাঁদের নিয়ে। তিনি নিজে আবিরের প্যাকেট নিয়ে প্রত্যেক আবাসিকের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কপালে আবির মাখিয়ে আসেন। এ বারও বসন্ত উৎসব হবে। প্রতি বারের মতো চিঠি এসেছিল।

‘‘ওই তো প্রথম রোদ নেমে এল তার মুখে, কপালে—

ট্রেন আসতে দেরি আছে। আরও দেরি, আরও দেরি হোক!’’

অল্প বয়সে দোল নিয়ে একটা রোম্যান্টিকতা ছিল। এখন আর সে ভাবে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে না। বালক বা কিশোর বয়সে দোল খেলতাম। একটু বড় হওয়ার পরে আর রং খেলতাম না। তার পরে আবার যখন আমার মেয়ে একটু বড় হল, মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে দোলের দিন চলে যেতাম শান্তিনিকেতনে। তখন আবার দোল খেলা নিয়ে একটা অন্য রকমের উৎসাহ কাজ করত।

রবিঠাকুরের গান আমার জীবনে বরাবর বসন্তের আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। এখনও দেয়। যখন রবীন্দ্রনাথের গানে শুনতে পাই ওই সব কথা, তখনই বসন্তকে আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের বসন্তকালীন যে সকল গান রয়েছে, যা বসন্ত উৎসবে গাওয়া হয়, সে সব যখন শুনি, তখন যেন বসন্তকে অনুভব করতে পারি।

গানের মধ্যেই আসল বসন্তকাল লুকিয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানে তার অনেকটাই ধরা পড়েছে। বসন্তের বিভিন্ন রং মিশে গেছে আমাদের জীবনে, রবীন্দ্রগানে। বাকি সবের মতোই তাকে জীবন থেকে আলাদা করা যায় না। কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না।

প্রেম আর বসন্ত আমার জীবনে কখনও পাশাপাশি বা হাত ধরাধরি করে আসেনি। দুটোই আলাদা আলাদা ভাবে এসেছে। তাই দুটোকে কখনও নিজের জীবনে মিশিয়ে ফেলি না। আজকে আমার স্ত্রী কাবেরী রাস্তা থেকে প্রচুর পলাশ তুলে এনেছে। থালায় করে সে পলাশ সাজিয়ে টেবিলে রাখা হয়েছে।

‘‘সে দিন বুঝিনি আর আজকেও বুঝি না

আজ তো ফাল্গুন শেষ। হেমন্তও ফুরোলো এখন।’’

এই শহরে হেমন্তকে চেনাই যায় না। তবে বসন্তের আলো খানিক হলেও জ্বলে ওঠে। আমাদের মফস্সল রানাঘাট শহরে যেমন প্রত্যেকটা ঋতু আলাদা আলাদা ভাবে বোঝা যেত। ষাট-সত্তর দশকে তখনও অনেক গাছপালা ছিল শহরে। পুকুর ছিল। এত বাড়ি হয়নি। তখন প্রকৃতিকে অনুভব করা যেত আরও গভীর ভাবে। এখন অনেক বাড়ি হয়ে গেছে। অনেক গাছ কাটা পড়েছে। পুকুর বোজানো। রানাঘাটও আর আগের রানাঘাট নেই, যে রানাঘাটের কথা আমি আমার বালক বয়েসে, কিশোর বয়েসে মনে করতে পারি।

আমার কবিতায় রানাঘাট বিভিন্ন সময়ে এসেছে। একলা তো ঘুরতাম প্রচুর। একলাই ঘুরে বেড়াতাম। সে স্মৃতি মনে পড়ে অনেক। রাত্রিবেলা ঘুরতাম, দিনের বেলাও ঘুরতাম। বসন্তকালের কথা আমার কবিতায় আছে। ‘ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা’ বলে আমার একটা কবিতার বই আছে। ‘আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো’ বলে একটা বই আছে। কিংবা ‘পাগলি তোমার সঙ্গে’ বলে যে বই আছে, সবেতেই বসন্তকালের কবিতার কথা উল্লেখ আছে। সে সবই আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে।

চাইলে মানসিক ভাবেই বসন্ত এনে ফেলা যায়। সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় না। এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের মনের মধ্যেই চিরবসন্ত থাকে। এমন মানুষ আছেন, যাঁদের বয়স স্পর্শ করে না। তাঁদের বসন্তের জন্য ঋতুর উপরে নির্ভর করে থাকতে হয় না।

আমি নিজে সে ধরনের মানুষ নই অবশ্য। এখন আমার কাছে বসন্ত হল গান। এখন আমি গানেই বসন্তকে খুঁজে পাই। দ্বিজেন্দ্রলালের গানে, অতুলপ্রসাদের গানে।

আর একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। আমার জীবনে যখন বসন্ত চলে যাচ্ছে, আমার মেয়ে বুকুনের জীবনে তখন বসন্ত আসছে। বসন্তের এই ওঠাপড়ার মধ্যেই বেঁচে থাকে ঋতু, তার পালাবদল। ‘‘কী বলতে চেয়েছিল? আঠাশ বছর আগে? তার সেই কথা হয়তো জানত বসন্তের শান্তিনিকেতন।’’

অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Joy Goswami Holi Celebration Holi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE