Advertisement
E-Paper

নাজিরারা আছে বলেই...

এক বেসরকারি হাসপাতালে দিন কয়েক যেতে হয়েছিল এক আত্মীয়ের অসুস্থতার জন্য। হাসপাতালের অপেক্ষাগৃহে কাটাতে হয়েছিল অনেকটা সময়।

দিলীপ মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩০

স্বার্থপরতা আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে তার মাত্রাবৃদ্ধি হয়েছে। নিস্পৃহ ভাবে অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য নেই। সংবাদমাধ্যমে তেমন খবর প্রকাশিত হয় নিয়মিত। প্রযুক্তির কল্যাণে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী, আর মানুষ সেই ছোট পৃথিবীর মধ্যে আরও ছোট ঘরে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে নিজেকে। সমাজের অসম বিকাশ, জীবন-জীবিকার সঙ্কট, যৌথ পরিবারের অবলুপ্তি, নিঃসঙ্গতা প্রভৃতি স্বার্থপরতার মাত্রাবৃদ্ধির কারণ। আমাদের এই বসুন্ধরা মানুষের স্বার্থপরতা আর নির্দয়তায় পীড়িত হচ্ছে প্রতি দিন, তবু তার ভারসাম্য বিনষ্ট হতে দেয়নি মানুষেরই স্বার্থহীন ভালবাসা, তার আত্মবিলোপী প্রেম।

এক বেসরকারি হাসপাতালে দিন কয়েক যেতে হয়েছিল এক আত্মীয়ের অসুস্থতার জন্য। হাসপাতালের অপেক্ষাগৃহে কাটাতে হয়েছিল অনেকটা সময়। বহু মানুষের জীবন-মৃত্যুর সঙ্কট, আত্মীয়-বান্ধবের আর্তনাদ এ সব দেখতে দেখতে মনে হল, প্রত্যেক মানুষের কিছু সময় হাসপাতালে কাটানো দরকার। তাতে তার নিজের দুঃখের তীব্রতা হ্রাস পাবে।

এই হাসপাতালে রাত্রিবাসের সময় আলাপ হল নাজিরার সঙ্গে। কুড়ি-বাইশ বছরের যুবতী। বিয়ে হয়েছে বছরখানেক। পটনা থেকে স্বামীকে নিয়ে এসেছে। তার কিডনির কঠিন অসুখ। অন্তত একটা কিডনি প্রতিস্থাপন না করলে বাঁচানো যাবে না। বিয়ের আগে নাজিরা জানত সে কথা। তার মা-বাবা রাজি হননি এই বিয়েতে। স্বাভাবিক। নাজিরা মাকে বলেছিল: ছেলেটাকে আমি ভালবাসি, বিয়ে হলেও ছেলেটা যে বাঁচবে তা বলা যায় না; কিন্তু বিয়ে না হলে সে আরও তাড়াতাড়ি মরে যাবে; আর সে মরে গেলে আমিও বাঁচব না। বিয়ের এক মাস পরে ছেলেটি আরও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। নাজিরা ধারধোর করে টাকা সংগ্রহ করে তাকে নিয়ে এল কলকাতা। একা। কিন্তু কিডনি দেবে কে! নাজিরা বলল সে তার একটা কিডনি দেবে। কিডনি পুরোটা ম্যাচ করেনি। চেষ্টা চলেছে ম্যাচ করানোর। ডাক্তার অবশ্য বলে দিয়েছেন কিডনি দিলে নাজিরার জীবনসঙ্কট হতে পারে। তা হোক, তবু তার স্বামী তো বেঁচে যাবে। এই ভালবাসা কি অন্ধ! নাজিরা কি আবেগ-পাগল! এটাই কি তার জীবনের সার্থকতা!

পরের দিন আলাপ হল কোয়েলের সঙ্গে। সন্ধের দিকে। স্বামীর অপারেশনের জন্য সারা দিন তাকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছি। ৩৭-৩৮ বছরের একটি মেয়ে সামলাচ্ছে সব, ডাক্তার আশা দিতে পারছেন না, অপারেশন সফল না হওয়ারই সম্ভাবনা, তবু সে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে, বন্ড সই করে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড, সে জেনেশুনে পান করছে বিষ। বিয়ের আগে তার স্বামীর বাইপাস সার্জারি হয়েছে, তার পর ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। আবার যে কোনও দিন স্বামীর স্ট্রোক হতে পারে, সন্তানলাভের সম্ভাবনা নেই— সব জেনেশুনেও সে ভালবেসেছে।

ভালবাসার সেই টান তাকে অসম লড়াইয়ের সাহস দিয়েছে। ওটি-তে নিয়ে যাওয়ার আগে সে অচৈতন্য স্বামীর কানে কানে বলে এসেছে: আমিও লড়াই করছি, তুমিও এ বার লড়াই করবে, মানবে না হার। অবাক হয়ে দেখছিলাম তাকে। সে বলল: কাকু, আমার যে সন্তান হবে না, সে কথা জানি। দুঃখ নেই, আমার দুঃস্থ অসহায় স্বামী তো এখন আমার সন্তান। নাজিরার ছিল প্রেমের টান, কোয়েলের প্রেম ও স্নেহ মিলেমিশে গিয়েছে।

মেদিনীপুরের মৃন্ময় হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তার বন্ধু বিজয়কে। ফুটবল খেলতে গিয়ে ইটের পাঁজায় পড়ে চোট লেগেছে পায়ে। গ্যাংগ্রিন হতে পারে, তাই পা কেটে বাদ দিতে হবে। বিজয় গরিব ঘরের ছেলে। মৃন্ময় একটু অবস্থাপন্ন। সে তার বাবা-মায়ের হাতে-পায়ে ধরে জমি বিক্রি করে বিজয়ের হাসপাতালের খরচ জোগাড় করেছে। বিজয়ের মা-বাবাকে নিয়ে এসেছে কলকাতায়। শুনলাম চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে সে বিজয়ের বাবাকে বলছে: তুমি কিছু ভেবোনি জেঠু, বিজয়ের কাঠের পা লাগিয়ে দিব, তার পরে বিজয় যা পারবিনি, তা আমি করে দিব, আমি তার বন্ধু না!

এই নাজিরা, কোয়েল, মৃন্ময়ের মতো মানুষেরা বসুন্ধরার ভারসাম্য নষ্ট হতে দেয় না। সংবাদমাধ্যমে এদের মতো মানুষদের খবর যে প্রকাশিত হয় না, তা নয়। তাবে তার তুলনায় খুন-জখম-ধর্ষণ-রাহাজানি-প্রতারণার খবর স্থান পায় বেশি। হয়তো এ সব খবরের বাজারমূল্য বেশি, হয়তো এ সব খবর ছাপিয়ে সংবাদমাধ্যম সমাজকে সচেতন করতে চায়। কিন্তু সংবেদনশীল মানুষের মনে এ সব খবর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে, পর পর নেতিবাচক খবর মানুষের প্রতি বিশ্বাস বিনষ্ট করে দেয়। সাধারণ মানুষ তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো শক্ত মনের মানুষ নয়, তাই সে মনের ভেতর গুনগুন করে নিরন্তর বলতে পারে না: মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো মহাপাপ...। সাধারণ মানুষ তাই হতাশ হয়ে জীবনানন্দের মতো বলে: পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন। অথচ শেষ পর্যন্ত মানুষই তো পৃথিবীর অসুখ সারানোর ক্ষমতা রাখে।

Love Human
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy