Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Post Editorial

লজ্জা লাগছে! অশিক্ষিত লোকজনে রাজনৈতিক দলগুলো ভরে যাচ্ছে

ত্রিপুরার বিলোনিয়ায় বিধ্বস্ত লেনিনের মূর্তি, তামিলনাড়ুতে আক্রান্ত পেরিয়ারের মূর্তি, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ। নকশাল আমলে মাথাচাড়া দিয়েছিল এই বর্বরতা। তালিবান রাজত্বেও দেখা গিয়েছে এই ছবি। ইতিহাস না জানার ফল— লিখছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা শিক্ষাবিদ।‘‘যাঁরা এটা করেছেন, তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তাঁরা ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী। কারণ, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত।’’

ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদ কলকাতায় এই পথে? শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভেঙে? লজ্জিত সুশীল সমাজ। —নিজস্ব চিত্র।

ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদ কলকাতায় এই পথে? শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভেঙে? লজ্জিত সুশীল সমাজ। —নিজস্ব চিত্র।

অমল মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮ ১৭:০২
Share: Save:

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বর্বরতার স্থান নেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিশ্বাস করে সহিষ্ণুতায়, সহমর্মিতায় এবং সহযোগিতায়। গণতন্ত্রে নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হয়। গণতন্ত্র বিশ্বাস করে শান্তিপূর্ণ এবং মসৃণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে। সেই কারণেই নির্বাচনের ব্যবস্থা। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল ক্ষমতাচ্যুত হয়, নতুন একটি দল ক্ষমতায় আসে— এমনটাই স্বাভাবিক। স্বভাবতই কেউই আশা করতে পারেন না যে, চিরকালই তাঁরা শাসকের আসনে থাকবেন। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে যে তাণ্ডব দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, নির্বাচনে জেতার পরে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে, পরে কখনও তাঁদের হারতেও হতে পারে। যে কাণ্ডকারখানা চলছে, সেটা গণতান্ত্রিক আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করছে।

ত্রিপুরায় সিপিএম হেরে যাওয়ার পরে জয়ী দল বিজেপি চূড়ান্ত ভাবে হামলা চালাচ্ছে। তারা লেনিনের মূর্তি ভেঙেছে, তারা সিপিএমের বিভিন্ন অফিস ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক ইতিহাসের কলঙ্ক।

আজ আবার জানতে পারছি যে, কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। যাঁরা এটা করেছেন, তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন। তাঁরা ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী। কারণ, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত।

যাঁরা শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভাঙতে এসেছিলেন, জানতে পারছি তাঁরা শ্যামাপ্রসাদকেই ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা বলে অভিহিত করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরা এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানেন না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় শুধু জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নয়। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, সেখানেই তাঁর পরিচয়। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সেখানেই তাঁর পরিচয়। অতএব লেনিনের মূর্তি ভাঙা যেমন অন্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি ভাঙাও তেমনই অন্যায়।

ঢেকে দেওয়া হচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তি। বুধবার কেওড়াতলায়। ছবি: পিটিআই।

অতীতে পশ্চিমবঙ্গে নকশাল যুগে বিদ্যাসাগরের মর্মর মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছিল। যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা বিদ্যাসাগরকে মনে করতেন একজন প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া। তাঁরাও ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের নকশাল ছাত্রদের সঙ্গে আমার তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। আমি তাঁদের প্রশ্ন করেছিলাম, মার্কসবাদে কোথায় বলা হয়েছে যে, বুর্জোয়া সমাজের সব কিছুকে ভেঙে ফেলতে হবে? তাঁরা আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন: ত্রিপুরার পর কলকাতা, এ বার মূর্তি ভাঙল শ্যামাপ্রসাদের

আজও আমি একই কথা বলছি। যে দল ত্রিপুরায় জয়ী হয়েছে, তাঁরা পরাজিত দলের উপরে নানা ভাবে অত্যাচার করছেন। লেনিনের মতো এক ঐতিহাসিক দার্শনিককে তথা বিপ্লবীকে তাঁরা অসম্মান করছেন। তাঁরা সবাই বিভ্রান্ত, কারণ তাঁরা ইতিহাস জানেন না। রাজনৈতিক দলগুলো যখন অশিক্ষিত মানুষে ভরে যায়, তখন এই ধরনের ঘটনাই ঘটে।

নব্বই দশকের গোড়ার দিকে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটতে দেখেছি। সেখানেও লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। সে-ও একই রকমের বর্বরতার নিদর্শন। পাশাপাশি আমরা এটাও দেখেছি যে, আফগানিস্তানে বুদ্ধমূর্তি ভেঙেছেন তথাকথিত তালিবানি বিপ্লবীরা। এগুলো কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

আরও পড়ুন: লেনিনের পাশে মমতা

ইতিহাসের চাকা যাঁরা পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চান, তাঁরা মানব সভ্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুগ যুগ যুগ ধরে মানুষের প্রচেষ্টায়, সেই সভ্যতাকে আবর্জনায় নিক্ষেপ করার কোনও অধিকার আধুনিক মানুষের নেই।

আমি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে ধিক্কার জানাই সেই সব বর্বর আক্রমণকারীদের, যাঁরা কয়েক দিন ধরে তাণ্ডব চালাচ্ছেন। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, গণতন্ত্র বিরোধী কোনও শক্তি স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। ফ্যাসিবাদ আজ অতীতের এক অন্ধকারময় ঘটনা। সেই ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করে যাঁরা আজকে তাণ্ডব চালাচ্ছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক, এ কথা ভাবতে আমি লজ্জা বোধ করছি। আমি ধিক্কার জানাচ্ছি, সেই সব আক্রমণকারীদের, যাঁরা ইতিহাসের গতি রোধ করে মানুষের সভ্যতাকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। এ দেশের এক জন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি নিন্দা জ্ঞাপনের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE