Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

দায়িত্ব

নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই বিপজ্জনক প্রবণতার ছবিটি এ-বারের ইরাক-প্রত্যাগত মৃতদেহগুলির মধ্য দিয়া প্রতীকায়িত হইয়া উঠিতেছে।

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৬
Share: Save:

দায়িত্ব বস্তুটি অনেক সময়ই সুখপ্রদ নহে। তবু মনে না রাখিয়া উপায় নাই যে, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কিন্তু আরও অনেক বড় অ-সুখ বহিয়া আনিতে পারে। তাই যত কঠিনই হউক, দায়িত্ববোধে স্থির থাকিবার বিকল্প নাই। এই সহজ সত্যটি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই ভুলিয়া গিয়াছিল। নতুবা ইরাকের সন্ত্রাসধ্বস্ত শহর মসুল-এ যে ৩৯ জন ভারতীয় শ্রমিক ইতিমধ্যেই হত হইয়াছেন, তাঁহাদের মৃত্যুসংবাদ লইয়া সরকার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করিতে পারিত না। চার বৎসর যাবৎ পরিবারের মানুষটির খবর না পাইয়া এই পরিবারগুলি বারংবার সরকারের দ্বারস্থ হইয়াছেন, বারংবার সরকারি প্রতিনিধিরা তাঁহাদের মিথ্যা আশ্বাসে ফিরাইয়া দিয়াছেন। ইরাক হইতে এই দলের একমাত্র প্রত্যাগত ব্যক্তি যখন জানাইয়াছেন যে তাঁহার অন্যান্য সকল ভারতীয় সহকর্মীকে আইএস ইতিমধ্যে নিধন করিয়াছে, সে-কথাকে কোনও মূল্য দেওয়া হয় নাই, বলা হইয়াছে তিনি অপপ্রচার করিতেছেন। সর্বোপরি, যখন সত্যই ৩৯ জনের নিশ্চিত মৃত্যুসংবাদ সরকারের কাছে আসিয়া পৌঁছাইল, তখনও এক আশ্চর্য ‘ভ্রম’বশত পরিবারগুলির সহিত সে-সংবাদ ভাগ করিয়া লইবার আগেই প্রচারমাধ্যমে তাহা বিজ্ঞাপিত হইয়া গেল, ফলত মৃত ব্যক্তির পরিবার তাঁহাদের প্রিয়জনের খবর জানিতে পারিলেন টেলিভিশনের মাধ্যমেই। কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রক এমন আচরণের যে-ব্যাখ্যাই দিক না কেন, তাহা ব্যাখ্যা-মাত্রই, সত্য নহে। ব্যাখ্যা দিয়া দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত স্খলন ঢাকা দেওয়া যায় না। এই পর্বের প্রতিটি ঘটনায় সেই স্খলন স্পষ্ট, উজ্জ্বল।

প্রশ্ন হইল, এহেন স্খলনের কারণ কী। সংসদে বিরোধীদের হাতে আর একটি অস্ত্র তুলিয়া দিয়া বিজেপি সরকারের কী লাভ হইল? বিদেশমন্ত্রী কি জানিতেন না যে ‘সব ভাল’ বলিয়া ছেলে ভুলাইবার কায়দাটিতে ঝুঁকির পরিমাণ বিরাট? তাহার অপেক্ষা সোজাসুজি পরিবারগুলির সহিত সত্য ঘটনার তথ্য বিনিময় করিয়া লওয়া একাধারে সংগত ও সুবিধাজনক? নিশ্চিত ভাবে কিছু না বলা গেলেও অনুমান করা যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকার আসলে দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি ভাবিয়া দেখে নাই। স্বল্পমেয়াদে লোকে কিসে খুশি হইবে, ইহাই তাহার নিকট গুরুত্বপূর্ণ ঠেকিয়াছিল। বর্তমান সরকারের অন্যান্য কাজকর্মেও এই স্বল্পমেয়াদি বিবেচনাভিত্তিক পদক্ষেপের পরিচয় মিলে। কোনও কিছু অঘটন ঘটিলে চুপ করিয়া থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করেন প্রধানমন্ত্রী হইতে তাঁহার সমগ্র মন্ত্রিসভা। এখনকার মতো সঙ্কট কাটিলে পরে দেখা যাইবে, ইহাই তাঁহাদের ভাবনার ধরন। ধরনটি আর যাহাই হউক, দায়িত্বজ্ঞানের পরিচায়ক নহে। এমন নেতৃত্বের হাতে নিজেদের ভার সঁপিয়া দিয়া নাগরিক সমাজ নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই বিপজ্জনক প্রবণতার ছবিটি এ-বারের ইরাক-প্রত্যাগত মৃতদেহগুলির মধ্য দিয়া প্রতীকায়িত হইয়া উঠিতেছে। সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকিলে, কিংবা নাগরিক কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি থাকিলে চার বৎসর ধরিয়া এমন বিপথচালনা করিয়া যাওয়া কঠিন হইত। ডিএনএ পরীক্ষার আগে নিশ্চয়ই নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না, এবং মসুলের যে বাস্তব তাহাতে দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষার কথা ভাবাও অসম্ভব ছিল— এ সবই ঠিক। কিন্তু যাহা সহজেই করা যাইত— উদ্বিগ্ন পরিবারগুলির সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রাখিয়া বাস্তব পরিস্থিতির অজ্ঞেয়তা ও অনিশ্চিতির সঙ্গে তাঁহাদের অভ্যস্ত করানো সম্ভব ছিল। এই সামান্য কাজটি যে করিয়া ওঠা গেল না, তাহা বর্তমান নেতৃস্থানীয়দের বিবেচনার অভাব বুঝাইয়া গেয়, ‘কিছুতেই কিছু আসিয়া যায় না’ এমন একটি দর্পিত মনোভাবও প্রকাশ করিয়া দেয়। ক্ষমতা যদি দায়িত্বের বদলে কেবলই দম্ভের জন্ম দেয়, দেশ ও দেশবাসীর পক্ষে তাহা বিরাট বিপদের লক্ষণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE