Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ক্ষমতার উৎস

একটি গভীরতর প্রশ্ন এই ঘটনার সূত্রে উঠিয়া আসে। কোনও জনপদের উপর অধিকার কাহার? প্রশ্নটি নিছক জমির মালিকানার নহে।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। পুলিশ গুলি চালাইয়াছে। সালটি ২০০৭ না ২০১৮, রাজ্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ না কি তামিলনাড়ু, এই প্রশ্নগুলি পারিপার্শ্বিক। মূল কথা হইল, রাষ্ট্র অসংবেদী এবং নির্বোধ হইলে পরিণাম কী দাঁড়ায়। একটি তামার কারখানাকে কেন্দ্র করিয়া এক শত দিন যাবৎ বিক্ষোভ চলিতেছিল তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে। বিক্ষোভকারীদের সহিত প্রশাসন কার্যত প্রথম বার সংযোগ স্থাপন করিল মঙ্গলবার। গুলির শব্দে। অন্তত এগারো জন মানুষের জীবনের মূল্যে। জেলাশাসকের দফতরের সম্মুখে যে কর্মসূচিতে গুলি চলিল, তাহার দিনক্ষণ ঘোষিত হইয়াছিল অন্তত তিন সপ্তাহ পূর্বে। প্রশাসন নড়িয়া বসে নাই। মানুষ কেন ক্ষুব্ধ, জানিতে চাহে নাই। সেই ক্ষোভ প্রশমনের কোনও ব্যবস্থা করে নাই। রাষ্ট্রের সহিত নাগরিকের সংলাপের যে পরিসরটি গণতন্ত্রে অতি স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য হওয়ার কথা, মুখ্যমন্ত্রী পালানিসামির প্রশাসন সেই পরিসরটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিয়াছে। অবশ্য তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব নহে। ১৯৯৯ সালে পুলিশের গুলি হইতে বাঁচিতে ১৭ জন শ্রমিক জলে ডুবিয়া মারা যায়। ২০১১ সালে ছয় জন দলিতের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে। রাষ্ট্র স্পষ্টতই হিংস্রতায় বিশ্বাসী। মানুষ কেন ক্ষুব্ধ তাহা যেমন জানিতে চাহে নাই, কী ভাবে কোনও বিক্ষোভ সামলাইতে হয় তাহাও ভাবে নাই। বন্দুকের নলই তাহার ক্ষমতার উৎস এবং একমাত্র মাধ্যম হইয়াছে। ভয়াবহ ঘটনার পরে পুলিশ আধিকারিকের শাস্তি বা তদন্তের নির্দেশ দিয়া মুখ্যমন্ত্রী পিঠ বাঁচাইতে তৎপর হইয়াছেন, কিন্তু তাহাতে রাজনীতির প্রয়োজন মিটিতে পারে, পাপক্ষালন হইবার নহে।

তুতিকোরিনে তামার কারখানা বিষয়ে মানুষের আপত্তি ছিল। অভিযোগ ছিল, এই কারখানা দূষণ ছড়াইতেছে এবং তাহাতে ক্যানসারের ন্যায় মারণরোগের প্রকোপ বাড়িতেছে। অভিযোগটি গুরুতর। দূষণের দিকে নজর রাখিবার বিষয়ে ভারতীয় শিল্পমহলের যে বিশেষ সুনাম নাই, তাহা তামিলনাড়ু প্রশাসনের অজানা থাকিবার কথা নহে। অতএব, যথেষ্ট অনুসন্ধান করাই বিধেয় ছিল। অভিযোগটি সত্য না-ই হইতে পারে, কিন্তু তাহাকে উড়াইয়া দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের নাই। যদি দেখা যাইত যে আশঙ্কাটি সত্য, কারখানা বন্ধ করিয়া দেওয়াই একমাত্র সমাধান। আর, আশঙ্কাটি অমূলক হইলেও সরকারের দায়িত্ব ফুরাইয়া যাইত না। বিক্ষুব্ধ মানুষের সহিত আলোচনায় বসিয়া, তাঁহাদের প্রকৃত তথ্য দিয়া, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হইয়া মানুষের ভয় দূর করিবার চেষ্টা করা বিধেয় ছিল। যত ক্ষণ না মানুষ বুঝিতে পারিতেন যে সত্য কোনও আশঙ্কা নাই, তত ক্ষণ অবধি শিল্প স্থগিতই থাকিত। আদালতের নির্দেশের এখন যাহা করিতে হইবে, তাহা সরকারের নিজেরই করণীয় ছিল।

একটি গভীরতর প্রশ্ন এই ঘটনার সূত্রে উঠিয়া আসে। কোনও জনপদের উপর অধিকার কাহার? প্রশ্নটি নিছক জমির মালিকানার নহে। আইনসঙ্গত পথে জমি কিনিয়া যদি কেহ একটি জনপদে কোনও কারখানা তৈরি করিতে চাহেন, বা অন্য কোনও কাজ, তাহাতে কি স্থানীয় মানুষের আপত্তি করিবার অধিকার থাকিতে পারে? বিশেষত, সেই আপত্তি যদি জমির ব্যবহারের এক্সটার্নালিটি বা অতিক্রিয়ার কারণে হয়? কোনও অঞ্চলের অধিবাসী যদি এলাকাটিকে জদুগোড়া হইয়া উঠিতে না দিতে চাহেন, তবে সেই দাবিটি কি জীবনের অধিকারেরই অঙ্গ নহে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেই সন্ধানপ্রক্রিয়াটি গণতান্ত্রিক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাহার পরিবর্তে রাষ্ট্র যদি হাতে বন্দুক তুলিয়া লয়, তবে তাহাতে গণতন্ত্রের কলঙ্ক। আদালত মৌলিক প্রশ্নগুলি তুলিয়াছে, উত্তর সন্ধানের জন্য প্রয়োজনে জনশুনানির নির্দেশ দিয়াছে। যথারীতি, আদালতই ভরসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

democracy Tuticorin Unrest Deaths
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE