Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সঙ্কীর্ণতার পরাজয়

ভিন্ন জাতি, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনের নিদর্শন ফরাসি ফুটবল দল। এবং তাহারা সফল। তারুণ্যের স্ফূর্তিতে, প্রতিভার উজ্জ্বলতায় সফল।

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সমুদ্রে ভাসমান এক নৌকা, আরোহীদের হাতে উত্তোলিত ফুটবল বিশ্বকাপ। নীল-সাদা-লাল ফরাসি পতাকাটি হাতের আকার লইয়া তাহা গ্রহণ করিতেছে।— ছবি আঁকিয়াছেন কৌতুকচিত্রী। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ জয় কেবল একটি দেশের জয় নহে, সারা বিশ্বের অভিবাসীদের জয়। সকল জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির মানুষকে গ্রহণ করিবার, সকলে মিলিয়া-মিশিয়া থাকিবার সদিচ্ছার পুরস্কার। চূড়ান্ত পর্বে ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়ার খেলাটি কেবল দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, যেন দুই ধারণারও লড়াই হইয়া উঠিয়াছিল। ক্রোয়েশিয়ার সকল ফুটবল খেলোয়াড় শ্বেতাঙ্গ। বিপরীতে ফরাসি দলে শ্বেতাঙ্গদের পাশে কৃষ্ণাঙ্গদের উপস্থিতি চোখে পড়িবার মতো। বেশ কিছু ফরাসি ফুটবলারের পিতামাতা শরণার্থী রূপে ফ্রান্সে আশ্রয় পাইয়াছিলেন। উনিশ-বর্ষীয় কিলিয়ান এমবাপে-র পিতা ফ্রান্সে আসেন ক্যামেরুন হইতে, মা আলজিরিয়া হইতে। কিলিয়ান বড় হইয়াছেন দরিদ্র অভিবাসী পল্লিতে। কিলিয়ান ব্যতিক্রম নহেন। রাশিয়ায় ফ্রান্সের তেইশ জনের দলে সতেরো জনই অভিবাসীর সন্তান, দ্বিতীয় প্রজন্মের ফরাসি। পল পোগবা-র পরিবার আসিয়াছিল গিনি হইতে, এন’গোলো কান্তের পিতামাতা পশ্চিম আফ্রিকার মালি হইতে। এই ঐতিহ্য পুরাতন। জ়িনেদিন জ়িদানের পিতামাতাও আলজিরিয়া হইতে আসিয়াছিলেন। ভিন্ন জাতি, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনের নিদর্শন ফরাসি ফুটবল দল। এবং তাহারা সফল। তারুণ্যের স্ফূর্তিতে, প্রতিভার উজ্জ্বলতায় সফল।

এই বৈষম্য-আকীর্ণ সময়ে ফরাসি দলের বিজয় যেন আশার বার্তা আনিল। এই মাসেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লন্ডনে সফরকালে ইউরোপে অভিবাসীদের আগমনকে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়াছেন, এবং আশঙ্কা করিয়াছেন যে ইহার ফলে ইউরোপ তাহার নিজস্ব সংস্কৃতি হারাইবে। এক রাষ্ট্রপ্রধানের এমন মন্তব্যের ফলে কৃষ্ণাঙ্গ-বিদ্বেষ আরও প্রশ্রয় পাইবে, এমন আশঙ্কা করিয়াছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু ফ্রান্সের বিশ্বকাপ-বিজয়ই কি ট্রাম্পের বক্তব্যের মোক্ষম জবাব নহে? ভিন্ন জাতি, ভাষাভাষীদের আশ্রয় দিলে তাহা দেশকে দুর্বল করিবে, ইতিহাস এমন আশঙ্কার বিপরীতেই সাক্ষ্য দিয়াছে। অভিবাসীরা তাঁহাদের পরিশ্রম, কষ্টসহিষ্ণুতা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ দিয়া তাঁহাদের আশ্রয়দাতা দেশকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন। জাতি-ধর্ম, ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র দেশের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে, নব নব প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়াছে। ট্রাম্প নিজের দিকে তাকাইলেও তাহার সাক্ষ্য পাইতেন। তাঁহার পিতামহ জার্মান, মাতামহ ছিলেন স্কটল্যান্ডের নাগরিক। তাঁহার মাতা কাজের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রে আসিয়াছিলেন। অভিবাসীর আগমন দেশে নানা সঙ্কট তৈরি করে, তাহা অনস্বীকার্য। ফ্রান্সেও ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের দুইটি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ সহিষ্ণুতার পরিবেশকে দুর্বল করিয়াছে। দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী দলগুলির প্রভাব বাড়িয়াছে। কিন্তু তাহার বিপরীত শক্তিও যে বর্তমান, ফুটবল সেই সত্যটি সম্মুখে আনিল। জয়ের উচ্ছ্বাসে রাস্তায় রাস্তায় সাদা-কালো, শহর-মফস্সল, সচ্ছল-দরিদ্র, সকল ফরাসি এক হইয়াছে। এই আবেগ হইতে বৈষম্যের সঙ্কীর্ণতা রুখিবার সমর্থনও কি আহরণ করিবে না ইউরোপ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

World Cup 2018 Immigrants Mentality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE