এমন দিন তবে আসিয়া গিয়াছে, যখন ভালবাসা শব্দটির অর্থ দাঁড়াইয়াছে ঠেঙানি দেওয়া। সুতরাং দেশপ্রেম শব্দটির অর্থ দাঁড়াইয়াছে দেশের নামে ভণ্ডামি ও গুন্ডামি। সেই ভণ্ডামি-গুন্ডামির অভিধানে দেশের বর্তমান রাজনীতির যে কোনও সমালোচনার পাশে সমীকরণ দিয়া লেখা হয়— দেশদ্রোহিতা। নাসিরুদ্দিন শাহের নামের পাশেও সম্প্রতি তাই লেখা হইল। স্বাভাবিক। নাসিরুদ্দিন শাহ দেশগুন্ডাদের রাজনীতি লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন— ভারতের অসংখ্য প্রগতিশীল সুবোধসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধি হিসাবেই। তাই তাঁহাকে দেশদ্রোহী নাম দিয়া ভারত হইতে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা বর্তমান সময়ে প্রত্যাশিতই ছিল। তাঁহার জন্য পাকিস্তানগামী বিমানে টিকিট কাটা হইয়াছে। অজমেঢ়-এ সাহিত্য সম্মিলনে তাঁহার বক্তৃতা বরবাদ হইয়াছে। দেশের অন্যতম রত্নসন্তান হিসাবে চিহ্নিত বিশ্ববরেণ্য অভিনেতা আজ পারিবারিক ভাবে বিপন্ন বোধ করিতেছেন। নাসিরুদ্দিন শাহ ও রত্না পাঠকের পরিবারে ধর্মের পরিচয় কী হওয়া উচিত এত দিন পর সেই বিষয়ে উদ্বিগ্ন হইতেছেন। ইহা ভারতের সাম্প্রতিকতম অর্জন, পরিচয়ও বটে। এই নূতন অর্জন বা পরিচয়ের জন্য গর্ববোধ করা উচিত না কি মস্তক হেঁট হওয়া উচিত— প্রতি ভারতবাসীকে আজ তাহা ভাবিতে হইবে। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ শব্দগুলির অর্থ আবার নূতন করিয়া ভাবিয়া দেখিতে হইবে। তাঁহারা কী ভাবিলেন, তাহার উপরই নির্ভর করিবে এই দেশের ভবিষ্যৎ।
এই ভাবনাপথ পরিক্রমার জন্য কিছু জরুরি কথা। দেশপ্রেমিক নামক সাম্প্রতিক ভণ্ড-গুন্ডারা ইতিহাস লইয়া উত্তেজিত হইলেও ইতিহাস কাহাকে বলে সেটাই তাঁহারা বোঝেন না। বুঝিলে, একটি ‘ঐতিহাসিক সত্য’ তাঁহারা না দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না। ভারত নামক ভৌগোলিক ভূখণ্ডটি কখনও কোনও একটিমাত্র ধর্ম-জাতি-গোত্র-বর্ণের সম্পত্তি ছিল না। একবিংশ শতকে আসিয়া ভারত সম্পর্কে একটিও কথা বলিবার আগে, এই দেশের এই বিচিত্রতার বিশিষ্টতাটি মানিতেই হইবে, স্বীকার করিতেই হইবে যে ইহা ‘ভারতীয় ইতিহাস’-এর প্রধান ও অপরিবর্তনীয় সূত্র। পাঁচ শত বৎসর আগে যাঁহাদের স্বদেশি মনে হইত, হাজার বৎসর পিছাইয়া গেলে তাঁহারাই এই দেশে বিদেশি। হিন্দুত্বের ঠিকাদাররা নাসিরুদ্দিন শাহকে পাকিস্তানে পাঠাইতেই পারেন, কিন্তু একই যুক্তিতে তাঁহাদেরও এখনই ভারত ছাড়িয়া আফগানিস্তান কিংবা তাজিকিস্তানের দিকে যাত্রা করিবার কথা। মুসলিমরা পারস্যের দিক হইতে আসিলে তথাকথিত হিন্দুরা হিন্দুকুশ পর্বতের দিক হইতে এই ভূখণ্ডে ঢুকিয়াছিলেন। অর্থাৎ কিনা, সুনীল জলধি হইতে যে দিন ভারতজননী উঠিয়াছিলেন, সেই গোড়ার দিনগুলিতে যে মানবকুল এই ভূখণ্ড অধিকার করিয়া ছিলেন, তাঁহাদের সন্ততিদের আজ ছত্তীসগঢ় কিংবা আন্দামানের জনবিরল অরণ্যভূমিতে পাওয়া গেলেও উত্তর বা মধ্য ভারতের গোবলয়ের অধিবাসীরা কোনও মতে সেই উত্তরাধিকার দাবি করিতে পারেন না। আক্ষরিক ভাবে এই ভারত মহামানবের সাগরতীর। ইহার মাটির উপর দাঁড়াইয়া যাঁহারা ভারতীয় মুসলিমদের দেশত্যাগ করার কথা বলেন, তাঁহারা নিজেরাই যেন দৃষ্টান্তপ্রতিষ্ঠার্থে আগে দেশ ছাড়িয়া বাহির হন।
রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ উল্লেখ যখন উঠিলই, তাঁহার একটি প্রত্যক্ষ বক্তব্যও বলা ভাল। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হইয়া তিনি শত বর্ষ আগে কয়েকটি বক্তৃতা দেন, ‘ন্যাশনালিজ়ম’ বইতে যেগুলি সঙ্কলিত হয়। মহাত্মা গাঁধী-সহ কতিপয় সমসাময়িক জাতীয়তাবাদী নেতার সহিত তাঁহার এই বিষয়ে মতবিরোধ ছিল। অন্যরা মনে করিতেন, আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করিলে জাতীয়তাবাদ উত্তম বস্তু— এখানেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সহিত আক্রমণাত্মক ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের মূল তফাত। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই যুক্তিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন নাই। তিনি বুঝিয়াছিলেন, ‘আত্ম’ শব্দটিই আসলে এক এক সময়ে এক এক ভাবে বিবেচিত হওয়া সম্ভব, ঠিক যেমন ‘রক্ষা’র ভাবনাও নানা রূপে চর্চিত হওয়া সম্ভব। তাই তিনি বিশ্বাস রাখিয়াছিলেন বিশ্বমানবতাবাদের উপর। রবীন্দ্রনাথ বড় মাপের মানুষ, তাঁহার বিশ্বমানবের চেতনা সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র হৃদয়ে ধরা না-ই পড়িতে পারে। তবে দেশমানবের চেতনাটিকেও বাদ দিয়া যদি দেশপ্রেমের বন্দোবস্ত করা হয়, তবে সেই ক্ষুদ্রতার জন্য একটি-দুইটি শব্দই পড়িয়া থাকে। ভণ্ডামি ও গুন্ডামি।
যৎকিঞ্চিৎ
বিরাট কোহালি যে হাবভাব মাঠে দেখাচ্ছেন, তা ভদ্র না অভদ্র? আগে ক্রিকেটকে বলা হত জেন্টলম্যান’স গেম। স্লিপে দাঁড়িয়ে গালাগালির কথা ভাবা যেত না। কিন্তু যেই দেখা গেল, দুঁদে দল পেল্লায় অভদ্রতাও করছে, এন্তার জিতেও যাচ্ছে, অনেকেই শিখতে লাগল। আর এখন তো সারা বিশ্বেই অভদ্রতার জয়জয়কার। তাই বিচ্ছিরি ব্যবহারের নতুন ঝলমলে নাম হয়েছে ‘আগ্রাসন’। হয়তো ক’দিন বাদেই, এই যোগের দেশে নতুন নিয়ম: ‘শীর্ষাসন’ আর ‘আগ্রাসন’ না জানলে, চাকরি নট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy