Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সে সময় পুজো সকলের যোগদানে চোখের সামনে গড়ে উঠত

দুর্গামেলা শব্দটা কোথায় গেল?

বেশ মনে পড়ে আমাদের ছোটোবেলায় প্যান্ডেলেই কেবল পুজো হত না। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সে গত শতকের আশির দশক। কলকাতার বাইরের কথা বলছি।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১২
Share: Save:

দুর্গাপুজো কোথায় হয়? এখন তো হয় আলো ঝলমলে প্যান্ডেলে। সেই সব প্যান্ডেল অনেক সময় রাস্তা আটকে দেয়। যান চলাচল তখন নিয়ন্ত্রিত। সব কিছু ছাপিয়ে প্যান্ডেলটি যেন নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে থাকে। এক প্যান্ডেলের সঙ্গে অপর প্যান্ডেলের প্রতিযোগিতা। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। অথচ বেশ মনে পড়ে আমাদের ছোটোবেলায় প্যান্ডেলেই কেবল পুজো হত না। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সে গত শতকের আশির দশক। কলকাতার বাইরের কথা বলছি। প্যান্ডেলের আয়োজনের বাইরেও ছোট-ছোট পুজোর উদ্যোগ করা হত। উদ্যোগ করতেন পাড়ার দাদা-কাকারা। সে ঠিক বারোয়ারি দেখনদারি পুজো নয়, এ কালের ক্লাব-কালচারের বিশাল আয়োজনও সেখানে ছিল না। ছোট আয়োজন, তবে তার কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই বৈশিষ্ট্য আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না, কেউ কেউ হারিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্য নকল করতে চান বটে। তবে সে নকলই, আসল নয় বলে সেখানে কৃত্রিমতা চোখে পড়ে, কানে বাজে। বার বার মাইকে ঘোষণা করা হয় আমাদের এই পুজোতলায় সম্প্রীতি বজায় রাখা হয়েছে, এই অঞ্চলের মানুষের মিলনে গড়ে উঠেছে এই পুজো। এই সব দিবারাত্র ঘোষণায় দাবি আছে, সত্য নেই।

দুর্গামেলা শব্দটি এখন হারিয়েই গিয়েছে। ছোটবেলায় বলতাম দুর্গামেলার মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে বাঁধানো, ঢাকা একটা মঞ্চ ছিল। প্রথম থেকেই ছিল না। কাঠামোটা আস্তে আস্তে পরিণতি পেয়েছিল, গড়ে উঠেছিল। পাড়ার সবাই খুশি হয়ে একটু একটু চাঁদা দিয়েছিলেন। তা জমিয়ে একটু একটু করে অনেক দিন ধরে মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। তাই তো হত তখন। মধ্যবিত্তের বাড়ি যেমন গড়ে উঠত অনেক দিন ধরে একটু একটু করে জমানো সম্বলে, এও তেমন। এখনকার মতো রাজনৈতিক দলের দানে কিংবা বিজ্ঞাপনের দাপটে রাতারাতি বড় হয়ে ওঠেনি সে দুর্গামেলা। যা ধীরে ধীরে সকলের যোগদানে চোখের সামনে তিল তিল করে গড়ে ওঠে তার মধ্যে সমাজমনের মমতা মিশে থাকে।

শুধু দুর্গাপুজো নয়, সারা বছরই সেখানে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে পাড়ার বড়-ছোট, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান মিলিত হতেন। দুর্গামেলার মেলা নামটি সারা বছরের এই মানুষের মেলা-মেশায় সার্থক। পাড়ার ছেলে-মেয়েরা সেই মাঠে বিকেল হলেই খেলতে যেত। শেখানো হত জিমন্যাস্টিক, ব্রতচারী। মাঝে মাঝেই পাড়ার ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান, নাটকের আসর বসত। সব চেয়ে মজা হত শরৎকালে, দুর্গাপুজোর আগে আগে। কোথা থেকে আসত এক জন সাইকেলওয়ালা। সেই তিন দিন তিন রাত্তির একটানা সাইকেল চালাত। আমরা ইস্কুল থেকে ফেরার পথে, খেলতে যাওয়ার সময় খানিক দাঁড়িয়ে পড়তাম। সাইকেল চলছে অবিরাম। সাইকেল চালাতে চালাতে খাওয়া, স্নান সব কিছু। এক জন মাথায় বালতি করে জল ঢেলে দিল, তার জামা-প্যান্ট এক সময় শুকিয়ে গেল। এক জন খাবার থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। সাইকেলওয়ালার সামনে খাবার ধরতেই সে সেখান থেকে ইচ্ছে মতো এক হাতে সাইকেল চালাতে চালাতে খাবার তুলে নিচ্ছে। খাচ্ছে, আবার আসছে। আমরা যারা হাফপ্যান্ট, তারা অবাক হয়ে দেখছি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চটাপট-চটাপট হাততালি দিচ্ছে। সাইকেলওয়ালা চলে গেলে পুজোর পর আসত ম্যাজিকওয়ালা। গলায় লম্বা লম্বা তিনটে ছুরি বেমালুম ঢুকিয়ে ফেলে বেঁচে থাকত সে। আমাদের দুই চোখ বিস্ময়ে ঠিকরে পড়ত। ভাবতাম মহিষাসুর এ কায়দা জানলে দেবীর অস্ত্রে সহজে কাত হত না। সামাজিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক যাত্রা আসত। পৌরাণিক যাত্রায় যিনি দেবী সাজতেন তাঁকে দেখার জন্য পাড়ার দিদি-কাকিমারা ভেঙে পড়তেন সাজঘরের সামনে, উঁকি-ঝুকি দিতেন। বিশেষ কৌতূহল ছিল সেই অভিনেত্রীর চুলের দৈর্ঘ্য নিয়ে। লম্বা চুল আসল না নকল, তাই নিয়ে বিচার চলত।

এই যে দুর্গামেলাকে ঘিরে যৌথজীবনের মিলনের ছবি, এর দিকে এখন পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় এই আয়োজনে পাড়ার সকলের যোগদান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শুধু তা-ই নয়, অহেতুক প্রতিযোগিতাও চোখে পড়ত না। আমাদের দুর্গামেলার ঠাকুরও ভাল, জেলেপাড়ার ঠাকুরও ভাল, মাঝিপাড়ারও ভাল। যার যার তার তার মতো। মনে হয় এই দুর্গামেলার ভাবনা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথম দু’দশকে যে স্বাদেশিক সাংস্কৃতিকতা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তারই অবশেষ। মেলা আর সমাজের গুরুত্ব আমাদের নবজাগ্রত চিন্তাবিদরা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। সেই মতো নানা আয়োজনও করতেন তাঁরা। বিখ্যাত হিন্দুমেলা তো মস্ত আয়োজন, বঙ্গভঙ্গের সময়েও ব্রতনিষ্ঠ মেলা আর সমাজের আবহে দুই বাঙালিকে মেলানোর সাধু চেষ্টা চোখে পড়ে। সেই সব চেষ্টার স্মৃতি সমাজ মনে মিলেমিশে গিয়েছিল। বড় মানুষদের ভাবনার ছায়া সাধারণ মানুষদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল। মেলা উপলক্ষে যাঁরা একত্র হন সহজেই তাঁদের হৃদয় খুলে আসে এই গুরুগম্ভীর ভাব আমাদের বাবা-কাকারা স্বাধীনতার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পরে আর সগর্বে বলতেন না। তবে কলকাতার বাইরে শ্যাম-সবুজ মফস্‌সলে অথবা আরও দূরে আধা শহরে এই সব দুর্গামেলা ছিল, বাঙালির সমাজমন সেখানে যৌথ উদ্যোগের মধ্যে খেলা করত।

সময় বদলায়। সেই সাইকেলওয়ালা, ম্যাজিকওয়ালা, যাত্রাওয়ালা ঘেরা দুর্গামেলাগুলি হারিয়ে গিয়েছে। নতুন ক্লাব-কালচারে পাড়ার মানুষের স্বাভাবিক সারা বছরের অংশগ্রহণ বিরল হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্লাবকে ঘিরে এখন রাজনৈতিক জটলা। আগে সামাজিকদের অংশগ্রহণে গড়ে উঠত ধীরে ধীরে সকলের দুর্গামেলা। তাতে ক্ষমতার প্রদর্শন ছিল না। এখন যে কোনও দলবদ্ধতাকেই ব্যবহার করতে চায় রাজনৈতিক দল, সব চেয়ে বড় কথা, দলবদ্ধ সামাজিকরা কোনও না কোনও ক্ষমতার সমীকরণে ঢুকে পড়ে নিজেদের অস্তিত্বকে জাহির করতে চান। হারিয়ে যাওয়া দুর্গামেলাগুলি ফিরে আসবে না। শুধু নিরুপায় স্মৃতিকথায় এখন তাদের ঠাঁই হয়।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja Participation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE