Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

অসহিষ্ণুতার আবহে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনার এটাই প্রাসঙ্গিক সময়

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না, অসহিষ্ণুতার আবহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড় করিয়ে রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে।আশঙ্কাটা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে৷ তার পরে পরাধীন ভারতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা, ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রে চোদ্দোবার গণতন্ত্রের উৎসব পালিত হয়েছে৷

মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে রবীন্ত্রনাথ।

মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে রবীন্ত্রনাথ।

আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০২:০০
Share: Save:

নির্বাচনের এই গণতান্ত্রিক উৎসবের মাস এ বছর বাঙালির কাছে আর এক উৎসবেরও মাস৷ রবীন্দ্র জন্মোৎসব৷ এই সমাপতনে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করায় নতুন কোনও অনুপ্রেরণা পাওয়া গেল কি না তা বিতর্কের বিষয়৷ কিন্তু দল মত নির্বিশেষে নির্বাচনী জনসভায় ফিরে ফিরে এলেন সেই রবীন্দ্রনাথই!

না, রবীন্দ্রনাথের বহুচর্চিত কিছু কাব্যকণা নেতৃবৃন্দের ভাষণে উঠে এল বলে এমন কথা বলছি না৷ সে তো প্রায়ই ঘটে থাকে৷ আসলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর‘সমস্ত জাতিগত ভূগোল বৃত্তান্তের অতীত’ বিশিষ্ট জাতীয়তাবোধ আর সহিষ্ণুতার ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন আমাদের ভাবনার নেপথ্যে৷

ধর্ম আর সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে তোষণের যে রাজনীতি এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় বিপদ তার সূচনাটা হয়েছিল ইংরেজ আমলেই৷ আশ্চর্যের কথা, তখনকার কোনও কোনও ঘটনা কী চমৎকার ভাবে মিলে যায় অতি সাম্প্রতিক অতীতের কোনও কোনও ঘটনার সঙ্গে৷ মহারাষ্ট্রে হিন্দুদের পুজো উপলক্ষে বাজনা বাজানো বন্ধ করেছিলেন একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট৷ সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘সুবিচারের অধিকার’ প্রবন্ধ৷

সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আরও পড়ুন: বিচারের পথ​

কী লিখলেন? ‘সংবাদপত্রপাঠকগণ অবগত আছেন, অল্পকাল হইল সেতারা জিলায় বাই-নামক নগরে তেরো জন সম্ভ্রান্ত হিন্দু জেলে গিয়াছেন। তাঁহারা অপরাধ করিয়া থাকিবেন, এবং আইনমতেও হয়তো তাঁহারা দণ্ডনীয়, কিন্তু ঘটনাটি সমস্ত হিন্দুর হৃদয়ে আঘাত করিয়াছে এবং আঘাতের ন্যায্য কারণও আছে। উক্ত নগরের হিন্দুসংখ্যা মুসলমান অপেক্ষা অনেক অধিক এবং পরস্পরের মধ্যে কোনো কালে কোনো বিরোধের লক্ষণ দেখা যায় নাই। একটি মুসলমান সাক্ষীও প্রকাশ করিয়াছে যে, সে স্থানে হিন্দুর সহিত মুসলমানের কোনো বিবাদ নাই–বিবাদ হিন্দুর সহিত গবর্মেণ্টের। অকস্মাৎ ম্যাজিস্ট্রেট অশান্তি আশঙ্কা করিয়া কোনো-এক পূজা উপলক্ষে হিন্দুদিগকে বাদ্য বন্ধ করিতে আদেশ করেন। হিন্দুগণ ফাঁপরে পড়িয়া রাজাজ্ঞা ও দেবসম্মান উভয় রক্ষা করিতে গিয়া কোনোটাই রক্ষা করিতে পারিলেন না। তাঁহারা চিরনিয়মানুমোদিত বাদ্যাড়ম্বর বন্ধ করিয়া একটিমাত্র সামান্য বাদ্য-যোগে কোনোমতে উৎসব পালন করিলেন। ইহাতে দেবতা সন্তুষ্ট হইলেন কি না জানি না, মুসলমানগণ অসন্তুষ্ট হইলেন না, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট রুদ্রমূর্তি ধারণ করিলেন। নগরের তেরো জন ভদ্র হিন্দুকে জেলে চালান করিয়া দিলেন। হাকিম খুব জবর্‌দস্ত, আইন খুব কঠিন, শাসন খুব কড়াক্কড়, কিন্তু এমন করিয়া স্থায়ী শান্তি স্থাপিত হয় কি না সন্দেহ। এমন করিয়া, যেখানে বিরোধ নাই সেখানে বিরোধ বাধিয়া উঠে, যেখানে বিদ্বেষের বীজমাত্র আছে সেখানে তাহা অঙ্কুরিত ও পল্লবিত হইয়া উঠিতে থাকে। প্রবল প্রতাপে শান্তি স্থাপন করিতে গিয়া মহাসমারোহে অশান্তিকে জাগ্রত করিয়া তোলা হয়।’

আশঙ্কাটা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে৷ তার পরে পরাধীন ভারতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা, ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রে চোদ্দোবার গণতন্ত্রের উৎসব পালিত হয়েছে৷ কিন্তু এই পঞ্চদশ উৎসবেও নির্বাচনী সভ্যতায় ‘সহিষ্ণুতা’ বজায় রইল না৷ একজন বিশেষ দেবতার মন্দির নির্মাণ এখনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হয় এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের মতো সেই প্রতিশ্রুতিও কেন রক্ষিত হল না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কোনও দেবতার জয়ধ্বনি প্রত্যাশিত,দায়িত্বশীল সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে দেয় আবার কোনও দেবতার জয়ন্তী-প্রতিযোগিতা চলে৷ আজও তাই রবীন্দ্রনাথের সতর্কীকরণ কেবল বিধিসম্মত নয়, ভয়ঙ্কর ভাবে প্রাসঙ্গিক, ‘মুসলমানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর নয়৷ শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না, অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে৷’

ধর্ম এবং তার সূত্র ধরে যে অসহিষ্ণুতার আবহ আজ গোটা দেশ জুড়ে তার উল্টো দিকে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনার এটাই বোধহয় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সময়। হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘...যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না।...দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে অন্নের জন্যে, আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না, অথচ নিজের অর্থ-সামর্থ্য সময় প্রীতি ভক্তি সবই দিচ্চে সেই বেদীমূলে যেখানে তা নিরর্থক হয়ে যাচ্চে। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৌৎসুক্য, এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই, এর প্রধান কারণ এই যে, এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে।...’

‘তাসের দেশ’-এর শিল্পীদের সঙ্গে কবিগুরু।

এই চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ১৯৩১-এ, অর্থাৎ মৃত্যুর দশ বছর আগে। তত দিনে তাঁর সমাজবোধ অনেক পরিণতি পেয়েছে। আর তার জন্য তাঁকে চক্ষুশূল হতে হয়েছে সনাতনীদের, তীব্র প্রতিরোধ, এমনকী ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও সইতে হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যেটা সেটা হল কোমর বেঁধে নিজের বক্তব্য নিয়ে ঝগড়া করতে নামেননি তিনি। মানুষকে তিনি ধর্মের উপরে তো বটেই, এমনকী দেশের উপরেও জায়গা দিয়েছেন। হেমন্তবালা দেবীকেই লিখেছিলেন, ‘আমার কথা ব্রাহ্মসমাজের কথা নয়, কোনো সম্প্রদায়ের কথা নয়, য়ুরোপ থেকে ধার-করা বুলি নয়। য়ুরোপকে আমার কথা শোনাই, বোঝে না; নিজের দেশ আরো কম বোঝে। অতএব আমাকে কোনো সম্প্রদায়ে বা কোনো দেশখণ্ডে বদ্ধ করে দেখো না। আমি যাঁকে পাবার প্রয়াস করি সেই মনের মানুষ সকল দেশের সকল মানুষের মনের মানুষ, তিনি স্বদেশ স্বজাতির উপরে। আমার এই অপরাধে যদি আমি স্বদেশের লোকের অস্পৃশ্য, সনাতনীদের চক্ষুশূল হই তবে এই আঘাত আমাকে স্বীকার করে নিতেই হবে’।

আরও পড়ুন: ছুটির দহন​

আঘাত স্বীকার করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সমষ্টি বা ইনক্লুসিভনেস-এর কথা বলা হয়,রবীন্দ্রনাথের সমাজ-ভাবনায় তার একটা পরিচয় বার বার পাওয়া যায়। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েই যে কাজের কাজ হয় সেটা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন না এটাও যে অসহিষ্ণুতার আবহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড় করিয়ে রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে তাঁর পদত্যাগের দাবি যখন উঠল তখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,‘আমি বরঞ্চ সমাজের অশ্রদ্ধাভাজন হইতে রাজি আছি কিন্তু সমাজকে অশ্রদ্ধা করিতে সম্মত নহি। অব্রাহ্মণকে বেদীতে বসাইলে সমাজ অশ্রদ্ধা করিবে এ কথাকে শ্রদ্ধা করিলে সমাজকে অশ্রদ্ধা করা হয়। যুক্তিহীন অর্থহীন আচারই যে হিন্দু সমাজের প্রকৃতিগত এ কথাকে আমি শেষ পর্য্যন্তই অস্বীকার করিব।...কোনমতে ব্রাহ্মণকে বেদীতে বসাইয়া দিলেই অদ্যকার হিন্দুসমাজ যদি আমাকে শ্রদ্ধা করে তবে সেই শ্রদ্ধা গ্রহণ করিয়া মানবসমাজের চিরকালীন সত্যধর্ম্মকে অশ্রদ্ধা করিতে পারিব না।’ আবার, ইংরেজদের প্রতি লিখছেন, ‘তোমাদের উচ্ছিষ্ট তোমাদের আদরের টুকরোর জন্যে আমার তিলমাত্র প্রত্যাশা নেই, আমি তাতে পদাঘাত করি৷ মুসলমানের শূকর যেমন, তোমাদের আদর আমার পক্ষে তেমনি৷ তাতে আমার জাত যায়, সত্যি জাত যায়---যাতে আত্মাবমাননা করা হয় তাতেই যথার্থ জাত যায়, নিজের কৌলীন্য এক মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যায়---তারপরে আর আমার কীসের গৌরব!’

পদে পদে রবীন্দ্রবাণীর অনুপ্রেরণা ব্যবহার করে চলা এ দেশের রাজনীতি আজ সেই কৌলীন্য হারিয়েছে৷ বাঙালির পঁচিশে বৈশাখে আজ তাই গভীর, গভীরতর অসুখ৷

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE