Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
National news

এ ভাবে সবাই মিলে ইঁদুর দৌড়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ব আমরা?

সন্তান-সন্ততির পড়াশোনা-প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইঁদুর দৌড়ে মেতে ওঠা অভিভাবকদের কথা আমরা অনেক শুনেছি, প্রত্যেকেই হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে সে সবের নমুনাও পেয়েছি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০৪:৪৫
Share: Save:

এ কোন প্রতিযোগিতা! এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে! সহপাঠী পরীক্ষায় নম্বর বেশি পাওয়ায় তাকে বিষ খাইয়ে দিচ্ছে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। প্রতিযোগিতার ভার জীবনের উপর কতটা চেপে বসলে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে এক সদ্য কিশোরী?

সন্তান-সন্ততির পড়াশোনা-প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইঁদুর দৌড়ে মেতে ওঠা অভিভাবকদের কথা আমরা অনেক শুনেছি, প্রত্যেকেই হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে সে সবের নমুনাও পেয়েছি। প্রতিযোগিতাটা যে অসুস্থ হয়ে উঠছে দিনে দিনে, সে বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ইঁদুর দৌড়টায় রাশ টানার চেষ্টা তা-ও হয়নি। বেলাগাম এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতাটার প্রতিটা পর্বকে নিয়ে আজ তাই জীবন-মৃত্যুর টানাপড়েনও শুরু হয়ে গেল অবধারিত ভাবেই।

মধ্যপ্রদেশের সাতনায় ঘটেছে ঘটনাটা। কিন্তু ঘটতে পারত পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরেও বা মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে বা হরিয়ানার অম্বালায় বা তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে। যে কিশোরী ঘটনাটা ঘটাল, দোষ তার নয়। কাল যদি কোনও শিশু আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে বসে, সে দোষও সেই শিশুকে দেওয়া যাবে না। অপরিণত বয়সেই যে দুঃসহ প্রতিযোগিতার মধ্যে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যে হিমালয়প্রমাণ চাপের মুখে তাদের ফেলা হয়েছে, তাতে বিপর্যয় আসতে বাধ্য।

বাড়িতে অভিভাবকের অন্তহীন প্রত্যাশা, স্কুলে পান থেকে চুন খসলেই শিক্ষকের রক্তচক্ষু, বৃহত্তর সমাজে সর্বক্ষণ উজাগর কটাক্ষের হুল— আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে অপরিণত মস্তিষ্ক ক্রমশ। ‘ব্যর্থতা’ শব্দটা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করতে থাকে। জীবনের কোনও ক্ষেত্রে, কোনও মূল্যেই ব্যর্থ হওয়া যাবে না, সর্বত্র সফল হতে হবে, অন্য সকলের সাফল্যকে টপকে যেতে হবে— এমন এক অবান্তর উচ্চাকাঙ্খা চারিয়ে দেওয়া হয়। টেলিভিশনে, হোর্ডিঙে, ব্যানারে, বিজ্ঞাপনে চোখ রাখা যায় না— তারাও যেন চোখ রাঙায়। হেল্‌থ ড্রিঙ্ক বা গুণমান সম্পন্ন খাদ্য বা চটকদার পোশাক বা ফর্সা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনেও জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার তাড়না। উচ্চতায়, শারীরিক সক্ষমতায়, গায়ের রঙে, খেলাধুলোয়, পড়াশোনায়, প্রতিভায়, মেধায়— কোনও ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকলে চলবে না, বিন্দুমাত্র ব্যর্থতাও অসম্মানজনক, বিজ্ঞাপনের বার্তাও আজ এমনই। জীবনের ধারণাটাই বদলে যাওয়া স্বাভাবিক নয় কি?

প্রতিযোগিতায় অসুস্থ হয়ে, আচ্ছন্ন হয়ে সহপাঠীকে বিষ খাওয়ালো সাতনার মেয়েটা। নিজেও আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করল। তা হলে এই প্রতিযোগিতা থেকে কী এল? শুধুই ধ্বংস নয় কি? ধ্বংসই কিন্তু হয়ে চলেছে নিরন্তর। ধ্বংস হচ্ছে বাল্য, নষ্ট হচ্ছে শৈশব, শেষ হয়ে যাচ্ছে কৈশোর, মুছে যাচ্ছে তারুণ্যের দিন— থাকছে শুধু ইঁদুর দৌড়, শুধু অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

আচ্ছন্ন শুধু মধ্যপ্রদেশের ওই কিশোরীই নয়, আচ্ছন্ন অনাগত বিভীষিকার হাতছানির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও শিশু শুধু নয়, আচ্ছন্ন প্রায় গোটা সমাজই। এই প্রবণতায় এখনই যদি রাশ টানা না যায়, আরও বড় বিপর্যয় কিন্তু আমাদের অপেক্ষায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE