Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
কী করে এত বড় ‘ম্যাজিক’ সম্ভব হল?

পুঁজি এই রাজনীতিই চাইছে

কী করে ২০১৩-য় বিজেপির পাওয়া ১.৫৪% ভোট এ বার একার জোরেই ৪৩ শতাংশের মতো হয়ে গেল? বিজেপির নতুন সঙ্গী, ত্রিপুরার জনজাতিদের দল, আইপিএফটি-র ৭.৩% ধরলে এই জোটের ভোট দাঁড়ায় ৫০.৩%।

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

ফারাকটা বাড়ছিল। ত্রিপুরায় ‘পদ্ম’ তার পাপড়ি মেলছিল ধীরে-ধীরে। বেশ খানিকক্ষণ ধরে চলা চার-পাঁচের ব্যবধান হঠাৎ বেড়ে দাঁড়াল দশ-বারোয়। চ্যানেলে আমার পাশে বসা সিপিএমের প্রবক্তা ব্যাপারটা মানতে পারছিলেন না। এই শিক্ষিত, ইংরেজি-পটু মানুষটি পেশায় ডাক্তার। বললেন, দেয়ার মাস্ট বি সামথিং রং সামহোয়ার। একটু পরে যখন এই ফারাক লাফিয়ে লাফিয়ে গত বারের (২০১৩) ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের আসন ব্যবধানের (৫০-১০) কাছাকাছি (৪৩ বিজেপি-১৬ বামফ্রন্ট), পৌঁছেছে তখন কেবল সিপিএম নয়, অনেকের মনেই এই প্রশ্নের উদয় হতে শুরু করেছে, কী করে এত বড় ‘ম্যাজিক’ সম্ভব হল?

কী করে ২০১৩-য় বিজেপির পাওয়া ১.৫৪% ভোট এ বার একার জোরেই ৪৩ শতাংশের মতো হয়ে গেল? বিজেপির নতুন সঙ্গী, ত্রিপুরার জনজাতিদের দল, আইপিএফটি-র ৭.৩% ধরলে এই জোটের ভোট দাঁড়ায় ৫০.৩%। যদি ধরে নেওয়া যায়, আইপিএফটি বাদে, গত বারের সব বিরোধী ভোট— কংগ্রেসের ৩৬.৫৩ + এনসিপির ০.০৩% ভোটের পুরোটাই বিজেপিতে চলে গিয়েছে, তবুও তা ৩৮ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি ওঠে। তা হলে এই একক রেকর্ড ভাঙা ‘লং জাম্পের’ রহস্যটা কী?

দুই, কী করে মাত্র মাস তিনেকের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বাধীন ঝোড়ো প্রচারে এই অসম্ভব সম্ভব হল? পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ৬ বছর আগে থেকে সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ইতিহাস ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লড়াকু নেত্রী ছিলেন। যার ছাপ ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনেও পড়েছিল। কিন্তু, প্রায় কোনও আন্দোলন ছাড়া, জয়ের কোনও বড় পূর্বাভাস ছাড়া, বিজেপির এই দাপুটে জয়, কেবল তিন দিকে বাংলাদেশ ঘেরা এই ছোট রাজ্যটিতে নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তো বটেই, জাতীয় রাজনীতিতেও তীব্র আগ্রহ সঞ্চার করেছে।

সিপিএমসহ বিজেপি-বিরোধী সব দল এর পিছনে এই ভোটে বিজেপির বন্যার মতো অর্থব্যয়, অত্যাধুনিক প্রচারযন্ত্র ব্যবহার, সর্বোপরি, নির্বাচন কমিশনসহ কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সুরক্ষা বাহিনীর ‘অপব্যবহার’-এর সম্মিলিত ছাপ দেখতে পেয়েছেন। বিপরীতে, বিজেপির ত্রিপুরা ও সর্বভারতীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, বহু দিন ধরেই বাম আমলের দীর্ঘ অনুন্নয়ন, উদ্যোগহীন গয়ংগচ্ছ শাসন, দলীয় ঔদ্ধত্য ও দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি চেয়ে আসছেন ত্রিপুরাবাসী। জাতীয় কংগ্রেস সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতে বার-বার ব্যর্থ হওয়ায় এ বার তাঁরা বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। একই সঙ্গে বিজেপি বলছে, হাওয়ায় নয়, কর্মীদের, বিশেষত সংঘ-পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘদিন ত্রিপুরায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ও বেশ কিছু সদস্যের আত্মবলিদানের ফল এই জয়।

দুটি বক্তব্যেই কিছু সারবত্তা থাকলেও কিছু প্রশ্নের তবু উত্তর মেলে না। যেমন, ভোট-মেশিন নিয়ে অভিযোগ; মানিক সরকার চার হাজার ভোটে জিতলেও ফল প্রকাশে বাধাদান; পশ্চিমবঙ্গের বাম নির্বাচনী ‘মেশিনারি’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল পুলিশ আধিকারিক পচনন্দার সঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিপ্লব দেবের একান্ত বৈঠক—
এ সব কিছুকে বিরোধীরা স্বভাবতই ‘চক্রান্ত’ হিসাবে দেখেছেন। অন্য দিকে, আরএসএস কর্মীরা দীর্ঘদিন ত্রিপুরায় কাজ করছেন ঠিকই, কিন্তু ত্রিপুরার তাৎক্ষণিক সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ছিল বিরোধী শিবিরকে (অর্থাৎ কংগ্রেসের বিধায়কদের) তছনছ করে বিজেপির দিকে নিয়ে যাওয়া। এই কাজটা করেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন ‘সেনাপতি’টি। তিনি প্রথমে এই বিধায়কদের ‘সিপিএমকে টক্কর দেওয়ার জন্য’ তৃণমূলে নিয়ে আসেন এবং নিজে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কিছু আগে এই বিধায়করা বিজেপিতে যোগ দেন। বলতে গেলে, সেটাই ত্রিপুরায় বিজেপির প্রথম রাজনৈতিক ‘ক্যু’। পরের চালে, বিজেপি জনজাতিদের দল, আইপিএফটি-র সঙ্গে জোট গড়ে। এখানেই বিজেপির ‘সোনার পাথরবাটি’র রাজনীতির শুরু।

১৯৯৬ সালে, জনজাতিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবিদার, এনএলএফটি-র ওপর প্রচণ্ড পুলিশি আক্রমণ নেমে এলে, আইপিএফটি তৈরি হলেও সাফল্য অধরা থেকে যায়। দলটি নতুন করে নজর কাড়তে শুরু করে ২০১৬ সালে জনজাতিদের জন্য পৃথক রাজ্য ‘টিপারাল্যান্ড’-এর জন্য আন্দোলন শুরুর পর। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, ১৯৪৭ সালে রাজশাসনে থাকা ত্রিপুরায় জনজাতিরা মোট অধিবাসীদের প্রায় ৮০ শতাংশ ছিলেন। কিন্তু দেশভাগের পর আগে পূর্ব পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ থেকে দফায় দফায় মুখ্যত হিন্দু বাঙালিরা ত্রিপুরায় আশ্রয় নেওয়ার ফলে জনজাতিরা সংখ্যায় আজ সমগ্র অধিবাসীদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। সঙ্গে বেড়েছে বাঙালিকেন্দ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও জমির মালিকানার বিরুদ্ধে জনজাতির ক্ষোভ। তার ফলে, এক সময়ের জঙ্গিপনা থেকে এখন পৃথক রাজ্যের দাবি, যা বিগত বাম সরকার জনজাতিদের ত্রিপুরি/ককবরক ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি ও জনজাতিদের পৃথক জেলা পরিষদ দিয়েও কমাতে পারেনি। বিজেপি এক দিকে (প্রকাশ্যে পৃথক রাজ্যের দাবি স্বীকার না করলেও) আইপিএফটি-র নানা দাবি মেটানোর কথা বলেছে এবং একই সঙ্গে, বাংলাদেশ থেকে চলে আসা বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্বে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কথা দিয়েছে। যদিও, বাঙালিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাধিক্যই জনজাতিদের ক্ষোভের মূল কারণ।

শিল্পবিহীন, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাহীন এই রাজ্যে ক্রমশ হতাশ হতে থাকা তরুণসমাজকেও বিজেপি, তার হাত ধরে পুঁজির আগমন ও কর্মসংস্থানের স্বপ্ন যেমন ফিরি করেছে, তেমনই সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ বলবৎ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মচারীদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছে। যে রাজ্যে সরকারি চাকরিই শিক্ষিত মানুষের প্রধান ভরসা, সেখানে রাজ্য সরকার দ্বারা ১০,৩২৩ জন প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগ প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গেলে, ও পরে তাদের অন্য সরকারি নিয়োগেও কোর্ট বাধা দিলে, হতাশার ব্যাপ্তি বেড়েছে।

তবে, পুঁজি অচিরেই এই অঞ্চলে প্রবল পরিমাণে ঢুকবে, কেবল ত্রিপুরায় নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই। ত্রিপুরাসহ নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ের ভোটকে এই নিরিখেও অনেকটা ব্যাখ্যা করা যায়। এই পুঁজি বিনিয়োগ ঘটবে ভারতের ‘লুক ইস্ট’ বা ‘পুবের দিকে তাকাও’ নীতির জন্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশসহ ‘আসিয়ান’ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সড়ক যোগাযোগসহ নানা পরিকাঠামো গড়ে তোলার এক মহা-উদ্যোগ এই নীতি, এশিয়ার এই অঞ্চলে বিশ্বায়নের অঙ্গ। উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ রাজ্যের মধ্য দিয়েই এই কর্মকাণ্ড চলবে, যে অঞ্চলগুলি নানা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরস্পর হিংসায় দীর্ণ) জনজাতিভিত্তিক জনসমাজে বিভক্ত। অথচ, এই অঞ্চলই পুঁজি ও পণ্যের অবাধ চলাচলে ভারতকে মেলাতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রমপ্রসরমাণ বাজারের সঙ্গে। নানা দেশ, আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানের বিপুল পুঁজি ও কারিগরি বিনিয়োগ ঘটবে এই অঞ্চল জুড়ে। এমন অবস্থায়, পুঁজি তার নিজস্ব যুক্তিতেই চাইবে নানা রাজনৈতিক পরিচয় ও ব্যবস্থায় বিবদমান অঞ্চলগুলিকে জাতীয় কেন্দ্রমুখী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যতটা সম্ভব যুক্ত করতে। ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া কংগ্রেসের চেয়ে বিজেপিই এই মুহূর্তে এই কাজে সবচেয়ে বিশ্বস্ত দল। অসমকে দিয়ে এই পরীক্ষার শুরু, এই জাল ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, হবে। ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর মতোই, নানা রাজনৈতিক কারণকে কাজে লাগিয়ে, এই ‘নতুন রাজনীতি’র প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।

অনুষ্ঠান শেষে, হতাশ হলেও, এই ব্যাখ্যায় কিছুটা সম্মতি জানিয়ে সিপিএমের ভদ্রলোক বললেন, সত্যিই এই সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর উত্তর-সত্য যুগে হয়তো এমনটাই হবে। আমাদের সংগঠনকে নতুন করে এ সব নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু এই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ‘বাইরে’র হঠাৎ-গজানো-নেতা-নির্ভর ‘নতুন রাজনীতি’তে চিরাচরিত সংগঠন ও মতাদর্শের গুরুত্বই বা কতটুকু!

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE