চরম দারিদ্র বাড়িতেছে আফ্রিকার দক্ষিণের দেশগুলিতে, কমিতেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ভারত আর সর্বাধিক দরিদ্রের বাসভূমি নহে। সেই স্থানটি আজ নাইজিরিয়ার। ভারত দ্বিতীয় স্থানে। অচিরে সেই স্থানটিও হয়তো লইবে কঙ্গো। ভারত হইবে তৃতীয়। এমনই বলিয়াছে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা। ইহাতে কি ভারতবাসী গর্বিত হইবে? জাতিদ্বন্দ্বে দীর্ণ, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপন্ন আফ্রিকার দেশগুলিতে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়িতেছে, ইহা সুখবর নহে। ভারত সর্বশেষ অবস্থানে থাকিবার লজ্জা হয়তো ঘুচিল। কিন্তু সেই স্বস্তিও মিলাইয়া যাইবে ভারতে দারিদ্রের বিপুল ও বিচিত্র রূপটি দেখিলে। ‘চরম দারিদ্র’ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির একটি পরিমাপ। দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার বা তাহারও কম ব্যয়ে যাঁহারা বাঁচিয়া আছেন, তাঁহাদের বুঝাইতে কথাটি ব্যবহৃত হয়। ভারতে সত্তর লক্ষেরও অধিক এমন মানুষ আছেন। কিন্তু পরিমাপ হিসাবে ‘ব্যয়ক্ষমতা’ অতি সঙ্কীর্ণ এবং একমাত্রিক। দারিদ্রকে বুঝিতে অর্থনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রপ্রধানেরা বহুমাত্রিক, পূর্ণতর সংজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছেন। দরিদ্র মানুষের বঞ্চনা ও অক্ষমতা বুঝিতে বিভিন্ন সূচক নির্মাণ করিয়াছেন। ‘চরম দরিদ্র’ বলিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ বোঝায় সেই মানুষদের, সম্মান ও সুরক্ষার সহিত বাঁচিবার উপযোগী ন্যূনতম পরিষেবা যাঁহাদের নাগালের বাহিরে, অর্থাৎ নির্মল পানীয় জল, শৌচাগার ও নিকাশি, পুষ্টি ও চিকিৎসা পাইবার উপায় যাঁহাদের নাই।
ইহার অর্থ, অক্ষমতা কেবল দরিদ্র ব্যক্তির নহে। রাষ্ট্র যে দরিদ্রের বঞ্চনা ঘুচাইতে অক্ষম, তাহাও চরম দারিদ্রের কারণ। ভারতে সরকারি পরিষেবা-বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা আজও সত্তর লক্ষের অধিক। এই সংখ্যা নাইজিরিয়ার তুলনায় কম, অথবা দশ বৎসর পূর্বের তুলনায় কম, এমনটা ভাবিলে সান্ত্বনা মিলিতে পারে। কিন্তু আজিকার সংখ্যাটিও শাশ্বত নহে। এক বৎসর বৃষ্টি না হইলে, বিশ্বের বাজারে তেলের দাম বাড়িলে, অর্থের বাজারে কোনও বড়সড় বিপর্যয় হইলে দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়িবে, তাহাতে বদলাইয়া যাইতে পারে চরম দরিদ্রের সংখ্যা। নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, দুঃস্থ পরিবারগুলির দারিদ্রসীমার নীচে নামিয়া যাইবার প্রধান কারণ অসুস্থতা। চিকিৎসার খরচ বহন করিতে চড়া সুদে ঋণ, ও তাহার কালান্তক ফাঁদ— অগণিত মানুষের ভবিতব্য।
যে দেশে মাত্র দশ শতাংশ মানুষ নিয়মিত বেতনের চাকরিতে নিযুক্ত, অধিকাংশের কোনও সামাজিক সুরক্ষা নাই, সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োগ বাড়িবারও ভরসা নাই, সেখানে দরিদ্রেরা প্রবল আর্থিক অনিশ্চয়তায় দিন কাটাইবেন, স্বাভাবিক। কে কখন ‘চরম দরিদ্র’ গোত্রে পড়িয়া যাইবেন, মোদীরও জানা নাই। ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, গত দুই দশকে দেশের ধারাবাহিক আর্থিক বৃদ্ধি হইয়াছে, কিন্তু তদনুযায়ী দারিদ্র কমে নাই। দক্ষিণ এশিয়ার যে সকল দেশের অর্থনীতি ভারতের তুলনায় দুর্বল, তাহারা অধিকাংশই দারিদ্র দূরীকরণে ও সামাজিক সক্ষমতায় অধিক সাফল্য পাইয়াছে। ভারতে মাথাপিছু আয় দুই হাজার মার্কিন ডলারও ছুঁইতে পারে নাই, চিনে তাহা আট হাজার ডলার ছাড়াইয়াছে। প্রতিবেশীদের পশ্চাতে থাকিবার লজ্জা কি আজ নাইজিরিয়াকে পশ্চাতে ফেলিবার আস্ফালন দিয়া ঢাকিতে হইবে? শেষ হইতে দ্বিতীয়, ইহাই জগৎসভায় ভারতের উপযুক্ত স্থান?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy