Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্যের প্রয়োজন ভারতেরও কম নয়

প্রতিবেশী নীতির সন্ধানে

ভোটের সময় রাজনেতাদের অনেক কথা বলতে হয়। যাকে বলে নির্বাচনী রেটরিক। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বার্থ নয়, ভারতের সার্বভৌম স্বার্থ তাতে ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০১:১০
Share: Save:

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সেই রণহুঙ্কারে ঢাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। মনে পড়ে, দিল্লির এক পাঁচতারা হোটেলে বাংলাদেশের এক সংবাদ চ্যানেল একটি অস্থায়ী স্টুডিয়ো তৈরি করে। ঢাকা থেকে কোনও সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেছিল, প্রধানমন্ত্রী হলে মোদী কি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রবল সংঘাতে যাবেন? কংগ্রেস-আওয়ামি লিগ সম্পর্কের এক বিপ্রতীপ কূটনীতি দেখা যাবে?

বলেছিলাম, ভোটের সময় রাজনেতাদের অনেক কথা বলতে হয়। যাকে বলে নির্বাচনী রেটরিক। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বার্থ নয়, ভারতের সার্বভৌম স্বার্থ তাতে ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। সঙ্ঘ পরিবারের এক সুপ্রাচীন আখ্যান হল, অনুপ্রবেশ বিরোধিতা। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় যখন বেগম খালেদা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী মদনলাল খুরানা এবং মুম্বইয়ের বাল ঠাকরে বরং বাংলাদেশিদের শনাক্ত-চিহ্নিত করে তাদের ফেরত পাঠাতে তৎপর হয়েছিলেন।

এখন ২০১৮। আবার আর একটি লোকসভা ভোট দুয়ারে। চার বছরে কী দেখলাম?

অনুপ্রবেশকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বরং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মধুরতর করতে তৎপর নরেন্দ্র মোদী। প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং মনমোহন সিংহ যা করেছিলেন, সেই পথ ধরেই এগোতে চাইছেন তিনি। শান্তিনিকেতনে শেখ হাসিনার সফরে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মোদীর কূটনীতি সেই প্রচেষ্টার সর্বশেষতম নমুনা।

বরং বলব, এ বার মোদী বাংলাদেশ নিয়ে গত চার বছরের বিদেশনীতির বেশ কিছু ভুল শোধরানোরও চেষ্টা করেছেন।

প্রথমত বুঝতে হবে, বাংলাদেশ নামক দেশটি ভৌগোলিক আয়তনে ছোট হলেও ভারতের কাছে তার কৌশলগত তাৎপর্য অপরিসীম। গত কয়েক বছর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে নানা ধরনের দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। ডোকলাম পরবর্তী অধ্যায়ে চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখনও অসহজ। চিন-পাকিস্তান অক্ষ এখনও মজবুত, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্থাপিত। উল্টে চিন-পাকিস্তান অক্ষের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে রাশিয়া। আফগানিস্তানে পুতিনের ভূমিকা নিয়ে আজও ভারত সন্দিগ্ধ। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সমস্যা নিয়ে মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ভারতীয় রাজনীতিতে অসন্তুষ্ট হয় বাংলাদেশ। তারা বার বার বলা সত্ত্বেও মোদী মায়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা নিয়ে নীরব ছিলেন। সে সময় চিন রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিষয়টি রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছয়। তখন আবার মোদী-সরকার দ্রুত ভুল শুধরে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ ও অন্যান্য সহযোগিতার কথা ঘোষণা হয়। ভারত মায়ানমারকেও প্রকাশ্যে চাপ দেয় যাতে ধীরে ধীরে এই উদ্বাস্তুদের মায়ানমার গ্রহণ করে।

শুধু রোহিঙ্গা নয়, বিজেপি লোকসভা ভোটের আগে অসমে আবার নাগরিকতা বিল আনতে তৎপর। বাংলাদেশে ডিসেম্বর মাসে ভোট, তার আগে এই নাগরিকতা বিল আনলে ঢাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ দিকে সঙ্ঘ পরিবার মনে করছে, ভোটের আগে সংসদে এই বিল আনতে পারলে তাদের মেরুকরণের রাজনীতি শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চল নয়, গোটা দেশে ভাল প্রভাব ফেলবে, তাদের উগ্র স্বদেশি ভোট-ব্যাঙ্কে।

প্রণববাবু তখন বিদেশমন্ত্রী। ওঁর সঙ্গে এক বার ঢাকায় গিয়ে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে এক চূড়ান্ত বিড়ম্বনায় পড়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণিকে প্রশ্ন করেছিলাম, পাকিস্তান বাংলাদেশকে তাদের স্বার্থে ‘বাফার’ হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট কি না। মন্ত্রী বিরক্ত না হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জমি কোনও মতেই সন্ত্রাসের জন্য ব্যবহার করতে দেবে না হাসিনার সরকার। কিন্তু ঢাকার সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ আমার প্রশ্নে খুব চটে যান। সাংবাদিক বৈঠকেই গোলমাল বেধে যায়। বাংলাদেশকে বাফার রাষ্ট্র বলার চেষ্টা হচ্ছে কেন? সে দিন বুঝেছিলাম, বাংলাদেশের মনস্তত্ত্বে ভারতকে নিয়ে একটা প্রবল সংবেদনশীলতা আছে। আসলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আলফা জঙ্গিদের ফেরত পাঠানো, পাক সাহায্যপুষ্ট জঙ্গি দমন— সব বিষয়েই তারা ভারতকে প্রভূত সাহায্য করেছে। বাণিজ্যের স্বার্থে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রানজ়িট নির্মাণ নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে, বাংলাদেশের মধ্যে এ ব্যাপারে তীব্র বিরুদ্ধ জনমত থাকা সত্ত্বেও। আমি বাংলাদেশের এই প্রভূত সাহায্য স্বীকার করেও বলতে চেয়েছিলাম ভারতের পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকাকে গন্তব্য স্থির করে পাকিস্তান আজও বাংলাদেশের মাধ্যমে জঙ্গি ঢোকানোর চেষ্টা করছে কি না! যা হোক, আমরা সবাই ভুল থেকে শিক্ষা নিই। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ, এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে গিয়েছি ঢাকায়। এ ভুল কখনও হয়নি। বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে খাটো করার চেষ্টা কখনওই করি না।

কিছু দিন আগে ঢাকায় হল অর্গানাইজ়েশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ়-এর সম্মেলন। এই মঞ্চে বাংলাদেশ ভারতকেও এ বার আমন্ত্রিত সদস্যের মর্যাদা দেয়। ফলে পাকিস্তানের ঘোরতর অস্বস্তি বাড়ে। বাংলাদেশ ‘হোস্ট কান্ট্রি’ ছিল বলেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ভাষাগত জাতিসত্তার সঙ্গে ধর্মীয় সত্তার একটা সংঘাত আছে। কট্টরবাদী জামাতপন্থীরা বাংলাদেশের মানুষকে বলেন ইসলামিক সত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিতে, আবার উর্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি আওয়ামি লিগের সহজাত প্রবণতা। বাংলাদেশের বইমেলায় দেখেছি দুই ধরনের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। একটা, কোরান ও ইসলাম গবেষণা, অন্যটি— মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন।

এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা যখন কলকাতায় এলেন, প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন, তখন ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গি কী? শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী এক সাংবাদিক রসিকতা করে বললেন, আমরা ছোট দেশ হতে পারি, কিন্তু আপনার বাড়ি যখনই আসি, কিছু নিয়ে আসি হাতে করে। আমরাও কি আশা করব না, আপনিও যখন আমার বাড়িতে আসবেন, হাতে একটা মিষ্টির বাক্স নিয়ে আসবেন?

তিস্তার ‘পানি’ নিশ্চয়ই সেই কাঙ্ক্ষিত মিষ্টির বাক্স হতেই পারত, কিন্তু আমি বলব, এই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই প্রক্রিয়ায় যথাযথ ভাবে সামিল করতেও ভুল হয়েছে অনেক। মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন শিবশঙ্কর মেনন, টি কে নায়ার প্রমুখ আমলা মহাকরণে এসেই যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করেন, তার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে। সঠিক দূত মনোনয়ন ও আলোচনার আবহ গড়ে তোলা ছিল বড় কাজ। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন ঢাকায় যান, তখন সেখানে দেখেছিলাম, মোদী মমতাকে সঙ্গে পেতে যথেষ্ট ব্যগ্র ছিলেন। ঢাকাস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন যাতে মমতা খুশি হন, তার জন্য বড় মার্সিডিজ়-বিএমডব্লিউ গাড়ি না দিয়ে দূতাবাসের এক কর্মচারীর ছোট গাড়িকে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়। তাঁর খাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে মুড়ি পর্যন্ত এনে রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর গাড়িতে মমতাকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার বাড়িতে যান।

সমস্যা হল, দেশে ফেরার পর আবার রাজ্যের ভোট এসে গেল। শুরু হয়ে গেল বিজেপি-তৃণমূল দ্বৈরথ। তিস্তায় জল না থাকলে দু’পক্ষই তা পাবে না। থাকলে তা কী ভাবে ভাগাভাগি হবে, সেই সমাধান সূত্রেই তো তিস্তা চুক্তি হতে পারে। প্রস্তাব ছিল তিস্তা চুক্তির জন্য যাতে উত্তরবঙ্গ কোনও ভাবেই জল থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য বিবিধ জলাধার নির্মাণ, সে জন্য রাজ্যকে বিশেষ আর্থিক অনুদান দেওয়া। সিকিমকে সতর্ক করা। কিন্তু সে সব প্রস্তাব নিয়ে দিল্লিই বা কী করছে?

তিস্তা হোক বা না হোক, এ বার শান্তিনিকেতনে মোদী বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশ নীতির ভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করেছেন। সমাবর্তনের ঐতিহ্য ভেঙে তিনি মমতার মঞ্চে বসার ব্যবস্থা করেন। মোদী দুনিয়ার কাছে বার্তা দিতে চেয়েছেন, হাসিনার জন্য তিনি কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ মেটাতেও তৎপর। মোদী-মমতার এই আপাত-সখ্য কতটা ঢাকার জন্য, কতটা লোকসভা ভোটের আগে দ্বিপাক্ষিক রণকৌশল, সে সব নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবু বলব, বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন ভারতকে, ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্যের প্রয়োজন তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE