ভারতের দেউলিয়া বিধি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাইয়াছে। বিশ্ব ব্যাংক হইতে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা, বহু প্রতিষ্ঠানই এই বিধিকে ভারতের সংস্কারপ্রক্রিয়ার একটি জরুরি অঙ্গ হিসাবে দেখিয়াছে। অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সেই বিধিকে কঠোরতর করিল কেন্দ্রীয় সরকার। অতঃপর, ‘যাঁহারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণখেলাপি করিয়াছেন বলিয়া নিশ্চিত হওয়া যাইবে’, সেই প্রমোটারদের আর খেলাপি সম্পত্তির নিলামে ভাগ লইতে দেওয়া হইবে না। সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ। খিড়কির দরজা দিয়া টাকা সরাইবার ইহা প্রশস্ত পথ ছিল। গোড়ায় সংস্থাকে দেউলিয়া ঘোষণা করিয়া বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে উঠিলে তাহা সস্তায় কিনিয়া লইবার মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করা বেশ পরিচিত পদ্ধতি। ভারতের ব্যাংকিং ক্ষেত্র যে বিপুল অনাদায়ী ঋণের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়িয়া আছে, তাহাতে এই গোত্রের কঠোর সিদ্ধান্তেরই প্রয়োজন। এবং, তাহার রাজনৈতিক দিকটিও ভুলিলে চলিবে না। গুজরাতের নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন বাকি। এই সময় যদি বার্তা দেওয়া যায় যে অসৎ ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করিতে সরকার অনমনীয় অবস্থান লইতেছে, তাহাতে নির্বাচনী জনসভায় হাততালি কুড়াইতে সুবিধা হইবে বইকি। কিন্তু, শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তটির বিরোধিতা করিলে ভুল হইবে। বেয়াড়া ঋণগ্রহীতাদের বাগে আনিতে কড়া ঔষধই চাই।
দাওয়াইটি কড়া হইয়াছে বটে, কিন্তু রোগের চরিত্র সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করা হইয়াছিল কি? প্রথম কথা, ঋণখেলাপির রোগটি নিছক ব্যাংক এবং ঋণগ্রহীতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে। বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ, এই লেনদেনের পিছনে রাজনৈতিক চাপ আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির পক্ষে সেই রাজনৈতিক চাপকে অস্বীকার করা কঠিন। অতএব, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রতিপত্তি বন্ধ করিবার প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না হওয়া অবধি রোগটি সারিবে না বলিয়াই সংশয়। দ্বিতীয় কথা, এই ঔষধে ঋণখেলাপি কমাইবার শক্তি কোথায়? বড়জোর, প্রথম বার ব্যাংককে ধোঁকা দেওয়ার পর দ্বিতীয় সুযোগ প্রাপ্তি বন্ধ করা যাইবে। তৃতীয়ত, ঋণখেলাপি করা প্রমোটারকে নিলামের বাহিরে রাখিলে বন্ধকি সম্পদের দাম আরও কমিবে কি না, সেই সংশয়ও থাকিয়াই যাইতেছে। আরও অনেক নীতির ন্যায় বর্তমান অর্ডিন্যান্সটির পিছনেও যথেষ্ট চিন্তাভাবনা নাই বলিয়াই সন্দেহ হয়।
কে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’র দায়ে দোষী হইবেন, সেই প্রশ্নটির কোনও নৈর্ব্যক্তিক উত্তর নাই। অর্ডিন্যান্স বলিতেছে, কাহারও সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য রূপে নিঃসংশয় হওয়ার পরই তাঁহাকে দোষী বলা হইবে। কিন্তু, সেই যুক্তির সীমারেখা কোথায় টানা হইবে, এই প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থাকিতেছে। ঋণখেলাপির কারণ একটি নহে এবং তাহার অনেকগুলিই ব্যবসার পরিচালকের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, সরকারি নীতির অদলবদল, এমনকী আদালতের নির্দেশ— এমন অনেক কারণেই ব্যবসায় প্রভূত লোকসান এবং ফলস্বরূপ ঋণখেলাপি হইতে পারে। আশঙ্কা থাকিয়া যায়, সংজ্ঞার মধ্যেই বিবেচনার অবকাশ থাকিবার ফলে এক দিকে যেমন বহু প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পাইয়া যাইবেন, অন্য দিকে তেমনই কিছু নিরপরাধ ব্যবসায়ীকে ভুগিতে হইবে। এবং, তাহার পিছনেও থাকিবে রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy