হাইফেন?: পাক প্রেসিডেন্ট মামনুন হাসানের (ডান দিকে) সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর করমর্দন। (পিছনে) চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। জুন ২০১৮। ছবি: রয়টার্স
দুই পায়ে দৃপ্ত পদক্ষেপ করতে মানুষের কত লক্ষ বছর লেগেছিল, বিবর্তনের ইতিহাসে তা বিধৃত। দু’পায়ে একই রকম চমৎকার ড্রিবল করা এতটাই মুন্সিয়ানা দাবি করে যা অনেক প্রবাদপ্রতিম ফুটবলারও তাঁর গোটা জীবনে আয়ত্ত করতে পারেন না। আর দু’নৌকায় পা দিয়ে একই ভাবে বৈঠা চালানো যে প্রায় অসম্ভব, তা বোঝার জন্য পদ্মা নদীর মাঝি হওয়ার দরকার পড়ে না!
বিদেশ নীতির প্রশ্নে সম্প্রতি এমনই ‘দু’পায়ে হাঁটার’ কঠিন প্রয়াস শুরু করল মোদী সরকার। জুনের প্রথম সপ্তাহে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে সিঙ্গাপুরে শাংগ্রি-লা সংলাপে যোগ দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর তার পরের সপ্তাহে চিনের কিনদাও প্রদেশে প্রথম বারের সদস্য হিসাবে মোদী পৌঁছলেন সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন (এসসিও) সম্মেলনে। এই দুই আন্তর্জাতিক মঞ্চেই ভারতের ভূকৌশলগত অবস্থানকে ব্যাখ্যা করে আঞ্চলিক সংযোগের জন্য সওয়াল করলেন। দ্বিপাক্ষিক পার্শ্ববৈঠক করলেন শক্তিধর রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে। কূটনৈতিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘ব্রাউনি পয়েন্ট’, তা-ও কিছুটা পকেটে ভরলেন নয়াদিল্লির ফিরতি বিমান ধরার আগে।
এই পর্যন্ত চমৎকার। কিন্তু আতসকাচের তলায় যদি এই দুই পৃথক বিশ্বমঞ্চকে রাখা যায়, তা হলে তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতার চিহ্নগুলিই কিন্তু প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছে। এই দুই সংগঠনের ভূগোল এবং মানচিত্র পৃথক বলেই তো শুধু নয়। চিন এবং রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন এসসিও কার্যত ইউরেশিয়া নামক অতিকায় ভূখণ্ডের কিছু রাষ্ট্রের জোট। আর শাংগ্রি-লা সংলাপ-মঞ্চটির ছড়ি স্যাম খুড়োর হাতে। যাঁর অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোলে একজোট হয়েছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় (এশিয়া-প্যাসিফিক)অঞ্চলের দেশগুলি। সোজা কথায়, একটি সংগঠন চিন-রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত এশিয়ার বুকে তৈরি হওয়া বিভিন্ন মহাদেশের অন্তর্গত রাষ্ট্রের জোট। অন্যটি আমেরিকার নির্দেশিত পথে তৈরি হওয়া ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয়’ (ইন্দো-প্যাসিফিক) অঞ্চলের প্রতিরক্ষাকেন্দ্রিক সংলাপমঞ্চ। সমুদ্র নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি মঞ্চে প্রতিনিধিরা একজোট হচ্ছেন মূলত চিনের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে। অন্যটিতে চিনেরই নেতৃত্বে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত জোট গঠনের চেষ্টা হচ্ছে।
কূটনৈতিক শিবিরে গুঞ্জন— এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাপ এবং নেউল, দু’তরফের গালেই চুম্বন সেরে এসেছেন মোদী। হ্যাঁ, এই মুহূর্তের ভূকৌশলগত বাস্তবতার বিচারে দু’টি মঞ্চ এতটাই ভিন্ন মেরুর।
কী সেই বাস্তবতা?
ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার আড়াই দশক পর, আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, রাশিয়া এবং চিন পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা গভীর করার পরেও, বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে এখন ছিলা-টানটান পরিস্থিতি। ট্রাম্প প্রশাসন দামামা বাজিয়ে ঘোষণা করেছে, চিন এবং রাশিয়ার সঙ্গে তাদের একটিই সম্পর্ক। খুব গোদা বাংলায় বলতে হলে, সেই সম্পর্ক বৈরিতার। রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের, চিনের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক ক্রমশ ঘোলা। আবহাওয়া আরও জটিল করে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে ট্রাম্প রীতিমতো তর্জায় মেতেছেন জি-৭-এর পশ্চিমি শরিকি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে এ বড় সুখের সময় নয়! আর বিশ্বের এই গভীরতর অসুখের মধ্যে ভারত একই সঙ্গে দু’রকম চাল দিতে দিতে এগোনোর চেষ্টা করছে। যে দিন মোদী এসসিও সম্মেলনে যোগ দিতে চিন রওনা হলেন তার ঠিক এক দিন আগেই সিঙ্গাপুরে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতা নিয়ে বৈঠক করলেন সাউথ ব্লকের কর্তারা। যে চতুর্দেশীয় অক্ষ কিনা ঘোষিত ভাবেই চিন-বিরোধী!
সরকারের কূটনৈতিক কর্তারা বলছেন, এসসিও মঞ্চে ঢোকার সুযোগ পেয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে সংঘাতক্ষেত্রগুলিকে কিছুটা কমানোর সুযোগ ভারত পাবে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও ধুলো পড়ে যাওয়া বন্ধুত্বের ফ্রেমটিকে ঝেড়েপুঁছে নেওয়ার অবকাশ থাকবে। সন্ত্রাসবাদ-বিরোধিতা, মৌলবাদ এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রকে শান্ত করতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু মুশকিল হল, এই সব কিছুই করতে হবে পাকিস্তানকে লেজুড় হিসাবে নিয়ে। দ্বিতীয়ত, প্রতি পদে আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির আস্থা হারানোর ভয় থাকবে। হাতে গরম উদাহরণ হিসাবেই আমরা দেখছি রাশিয়া থেকে পূর্বনির্ধারিত ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে গিয়ে মার্কিন আইনের জুজুর সামনে কার্যত লেজেগোবরে হতে হচ্ছে সাউথ ব্লককে। বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনকে শুধু এটা বোঝাতে যে এই অস্ত্রচুক্তির ব্যাপারে দীর্ঘ দিন আগেই মোদীর কথা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল রাশিয়াকে।
তবে ভারত অবশ্যই একমাত্র দেশ নয় যে পরস্পরবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করছে। বহু দেশই তা করেছে বা করে থাকে। পাকিস্তান যার মধ্যে অগ্রগণ্য। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার কথা মনে করে দেখুন। সে সময় মার্কিন সামরিক জোটের অন্যতম অংশীদার হয়েও কমিউনিস্ট চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমঝোতা বজায় রেখে চলেছিল পাকিস্তান। চিন এবং আমেরিকা সে সময় পারস্পরিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে চলেছে।
এটা ঘটনা যে ভারতের বেশির ভাগ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ এই মুহূর্তে সমুদ্রশক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গেই বেশি। আবার পশ্চিমের দেশগুলিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছেন। অন্য দিকে আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংযোগ বেড়েছে। ফলে বহুমুখী কূটনীতিকে সামলানোর একটা প্রাসঙ্গিকতা রয়েছেই।
তাই ভারতীয় বিদেশ নীতির মূল প্রশ্ন এটা নয় যে ভারতের দু’টি ভিন্ন অভিমুখে নিজেদের সম্পর্ক বিস্তারের চেষ্টা কূটনৈতিক নৈতিকতার বিচারে ঠিক না ভুল। প্রশ্ন এটাই যে দু’দিক থেকে জোগাড় করা সুযোগকে কতটা বাস্তবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। সমুদ্রপথ এবং ইউরেশিয়া, দু’দিকের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার অর্থ এই নয় যে, এই দু’টি সম্পর্কের চরিত্র এবং সুযোগ একদম এক রকমই হবে। বরং তা হবে ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে আত্তীকরণ করে তার থেকে প্রয়োজনীয় রসটুকু নিংড়ে নেওয়ার মতো কূটনৈতিক পরিপক্বতা এই সরকারের রয়েছে কি না, প্রশ্নটা আসলে তা নিয়েই।
ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিশ্বায়নের হাওয়ায় সুযোগ এসেছিল একই সঙ্গে বিভিন্ন আকাশে নিজেদের ঘুড়ি ওড়ানোর। তবুও কিছু পুরনো ধ্যানধারণা এবং জাড্যের ফলে লাটাইয়ে মাঝে মধ্যেই টান পড়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে সংঘাত ফের চাগিয়ে ওঠার এই অবেলায় সেই টান আরও বাড়বে বই কমবে না। কিনদাও এবং সিঙ্গাপুরে মোদী যে ভাবে ভারতের বিদেশ নীতিকে তুলে ধরেছেন তাকে সাউথ ব্লক ব্যাখ্যা দিচ্ছে দু’পায়ে হাঁটার (টু লেগড ডিপ্লোম্যাসি) সঙ্গে। কিন্তু বিষয়টি শুধু দু’পায়ে হাঁটাই তো নয়। এসসিও-র মঞ্চে ভারতকে যাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হবে সেই আরও এক নবনির্বাচিত সদস্য দেশটির নাম পাকিস্তান। আমেরিকা দীর্ঘ দিন ধরে ভারত এবং পাকিস্তানকে একটি হাইফেনে রেখে তাদের জাতীয় স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগিয়ে এসেছিল। সেই বন্ধনীর স্মৃতি ধূসর হওয়ার আগেই চিনের উদ্যোগে ফের ফিরে এল সেই হাইফেনটি, নবকলেবরে। আমেরিকা না-হয় অতলান্তিকের ও-পার থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কলকাঠি নাড়াতে চেষ্টা করে গিয়েছে। তাদের স্বার্থও ছিল অনেকাংশে আফগানিস্তান-কেন্দ্রিক। কিন্তু চিন নিকটতম প্রতিবেশী দেশ, যাদের পাল্লা দৃশ্যতই বহু কারণে পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকা। অমিত শক্তিশালী এই দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা গোটা উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক খেলোয়াড়। নয়াদিল্লিকে চাপে রাখতে ইসলামাবাদকে কাজে লাগানো যাদের অন্যতম কার্যকর আয়ুধ।
এসসিও সম্মেলন শেষ হতে না হতেই চিনের বিদেশমন্ত্রী ভারত এবং পাকিস্তানকে একই পাটাতনে দাঁড় করিয়ে বোঝাতে শুরু করেছেন, নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদের দ্বিপাক্ষিক সঙ্কটমোচনের চাবিকাঠি আসলে তাঁদেরই হাতে। আর তালাটি রয়েছে এসসিও-র মধ্যেই! বিদেশ নীতির নবাগত ছাত্রও জানেন, এটি অশনি সঙ্কেত ছাড়া কিছু নয়। পরিস্থিতি ক্রমশ এমন না দাঁড়ায় যে ভারতকে এসসিও মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে আওড়াতে হচ্ছে সেই পুরনো এবং পরিচিত বাঁধা গতের বয়ানটি, যা তারা বার বার বিভিন্ন মঞ্চে এবং মাধ্যমে বলে এসেছে আমেরিকাকে। সেটি হল— ভারত এবং পাকিস্তানের সমস্যা দ্বিপাক্ষিক স্তরেই মেটানো হবে, এখানে কোনও তৃতীয় দেশের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।
তখন কিন্তু দু’পায়ে হাঁটতে গিয়ে প্রতি পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy