মোহন ভাগবতের মন্তব্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপমান হইয়াছে কি না, তাহা আদৌ কোনও প্রশ্নই নহে। কোনও এক ব্যক্তিবিশেষের কথায় গায়ে আঁচড় প়ড়িবে, ‘ভারতীয় সেনা’ নামক প্রতিষ্ঠানটি এমন ভঙ্গুরচিত্ত নহে বলিয়াই দেশবাসী বিশ্বাস করিতে পারে। তিন দিন মাত্র সময় পাইলেই স্বয়ংসেবক সংঘের বীররা খাকি হাফপ্যান্ট পরিয়া সিয়াচেনে ছুটিতে পারিবেন কি না, সেই তর্কও অবান্তর। ভারতীয় রাজনীতি আপাতত এই অবান্তরের চর্চাতেই মাতিয়াছে। এবং, একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনার বাহিরে থাকিয়া যাইতেছে। ভাগবতের বক্তৃতায় সেনাবাহিনীর সহিত তুলনাটি আসিল কেন? সংঘের বিবৃতি বলিতেছে, তিনি শৃঙ্খলাপরায়ণতার কথাটিতে জোর দিতেই এই প্রসঙ্গ আনিয়াছিলেন। নাগপুরের অনুশীলনে শৃঙ্খলার মাহাত্ম্য সুবিদিত, কিন্তু চরিত্রগঠনের শৃঙ্খলাকে যদি ভাগবত সচেতন ভাবে সেনাবাহিনীর সামরিক শৃঙ্খলার সহিত এক করিয়া ফেলেন, তবে আঁচ করা চলে, আখ্যানটির খানিক অকথিতও আছে। সেই উহ্য কথাটি হইল, ভাগবত আদি নেতারা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে সমর-প্রস্তুত বাহিনী হিসাবেই দেখেন। তাঁহাদের নিকট শৃঙ্খলার অর্থ নিজেকে জিতিতে সমর্থ হওয়া নহে, বাহিরের শত্রুকে জয় করিবার শক্তি অর্জন। তাঁহাদের শৃঙ্খলা গাঁধীর নহে, হিটলারের। হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি কেন সর্বদাই ‘অপর’ খুঁজিয়া বেড়ায়, তাহা বোঝা সম্ভব— অপর, অর্থাৎ শত্রুকে চিহ্নিত না করিতে পারিলে শক্তি প্রয়োগ করিবে কোথায়? কখনও মুসলমান, কখনও পাকিস্তান, কখনও পাশ্চাত্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষ— শত্রুর অভাব নাই। মোহন ভাগবতদের শৃঙ্খলার্জিত শক্তিও, অতএব, ফেলা যায় না।
স্বয়ংসেবকরা কি তিন দিনের নোটিসে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে যাইতেই প্রস্তুত, না কি হঠাৎ কলেরা বা প্লেগ ছড়াইয়া পড়িলে আতুরদের চিকিৎসা করিতেও তাঁহারা সমান প্রস্তুত হইয়া আছেন? অথবা, ভাঙিয়া যাওয়া নদীবাঁধ মেরামতিতে? এই প্রসঙ্গগুলি কেন ভাগবতের বক্তৃতায় আসিল না? প্রশ্নগুলি জরুরি, কারণ দেশের এই কাজগুলি করিবার জন্যও শৃঙ্খলার প্রয়োজন। কিন্তু, তাহাতে ‘অপর’-এর সহিত যুদ্ধ করিবার পরিসর নাই, বরং সর্বজনীন সংগঠনের দাবি আছে। সেই কারণেই কি শৃঙ্খলার এই রূপগুলি মোহন ভাগবতদের মানসজগতে থাকে না? শৃঙ্খলা বলিতে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বলিতে, জাতীয়তাবাদ বলিতে তাঁহারা কেবল হিংস্রতার ভাষ্যটিকেই বুঝেন কেন?
যে শক্তি নিজেকে সংযত করিবার নহে, অপরকে জয় করিবার, তাহার সহিত হিংস্রতার সম্পর্ক অনপনেয়। ভারতীয় রাজনীতি হিংস্র হইয়াছে, এবং ‘বেসরকারি সেনা’-র ধারণাটিও তাহার মূলস্রোতে আসিয়াছে। করণী সেনা সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। কিন্তু, সেনাগন্ধী নামধারী, এবং হিংস্রতায় অভ্যস্ত রক্ষণশীল রাজনৈতিক সংগঠনের দাপটে ভারত ক্রমে অভ্যস্ত হইতেছে। প্রবণতাটি বিপজ্জনক। এমনকী, হিন্দুত্ববাদী সরকারের পক্ষেও। কারণ, এই সংগঠনগুলি যদি এক বার ‘বৈধতা’ অর্জন করে— ভারতে যে প্রক্রিয়াটি বহু দূর গড়াইয়া গিয়াছে— তবে তাহাকে সংযত করা কার্যত অসাধ্য। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী ভিন্ন অপর কোনও সংগঠনের হাতে, অর্থাৎ যে কোনও বেসরকারি সংগঠনের হাতেই, দমনের অধিকার থাকিলে তাহা শেষ অবধি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলারক্ষার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং তাহার পরিণতি সমাজের পক্ষে মারাত্মক। টমাস হবস-এর ‘লিভাইয়াথন’-এ বর্ণিত প্রাকৃতিক অবস্থার কাল হইতে সমাজ যে আধুনিক শৃঙ্খলায় উপনীত হইয়াছে, তাহার প্রধানতম কারণ, শাসনের অধিকারটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কুক্ষিগত হওয়া। ভাগবতদের বেসরকারি সেনা ভারতকে মধ্যযুগে ফিরাইয়া দিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy