Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বহুত্ব ও ভারত

গণতন্ত্রের এক ও একমাত্র আরাধ্য এখন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতা। আদর্শ ইত্যাদি নেহাত ছেলেমানুষি।

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫০
Share: Save:

মোদী হইতে যোগী: বিগতপ্রায় বৎসরটিকে এই একটি শব্দবন্ধে বর্ণনা করিলে ভুল হইবে না। হিন্দুত্ববাদের সংকীর্ণ রাজনীতি এ দেশে নূতন নহে, বিজেপির শাসনও নূতন নহে, কিন্তু ভারত এই বৎসরে যে বিন্দুতে আসিয়া পৌঁছাইল, তাহা আগে অভাবিত ছিল। গোটা বৎসর জুড়িয়া চলিয়াছে অসহিষ্ণুতা ও অনুদারতার উদ্দাম নির্ভীক চর্চা। বৎসর জুড়িয়া একটি দিনও যায় নাই যে দিন হিন্দুত্বের নামে নির্যাতন ও নিধনের সংবাদ অমিল থাকিয়াছে। মুসলিম-অধ্যুষিত প্রদেশটিতে মুসলিম-নিধনের প্রতিজ্ঞাকারী প্রার্থীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে জিতাইয়া আনা হইতে গুজরাত ভোটে সাম্প্রদায়িকতার তাসে জয়লাভ, জাতীয় সংগীত গাইবার বাধ্যবাধকতা হইতে শুরু করিয়া বড়দিন পালনের প্রথা তুলিয়া দিবার প্রস্তাব, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক মোতায়েন হইতে কলেজে কলেজে গণতন্ত্র বিষয়ক বক্তৃতা বাতিল, কল্পকাহিনির রানিকে অপমান করার অভিযোগে ভাঙচুর নৈরাজ্য হইতে শুরু করিয়া হিন্দুত্ব-বিরোধী সাংবাদিককে বাড়ির চত্বরে নৃশংস ভাবে হত্যা, মুসলমান মজুরকে পুড়াইয়া মারা হইতে গোহত্যার অভিযোগে গ্রামীণ মানুষকে প্রশ্নহীন নিধন: এ সবই ২০১৭ সালের একের পর এক উপহার। ভারতীয় রাজনীতি প্রমাণ করিয়াছে, কত অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অসহিষ্ণুতার তলানিতে তাহা নামিতে পারে। সংখ্যালঘু, দলিত, প্রান্তবাসী, সকলের উপরেই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের ফাঁস কী ভাবে চাপিয়া বসিতে পারে। তীব্র ঘৃণা ও অপশিক্ষার দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটিকে কী ভাবে প্রহসনে পরিণত করা যাইতে পারে।

এই রাজনীতিকরা সেই দেশের নাগরিক, কিছুদিন আগেও দুনিয়াময় যাহার পরিচয় ছিল ‘গাঁধীর দেশ’। এই কু-রাজনীতিকদের হদিশ মহাত্মা গাঁধী ভালই জানিতেন, তাই মৃত্যুর ঠিক আগেও বার বার অনুরোধ করিয়াছিলেন, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির পথ হইতে ভ্রষ্ট না হইতে। নিজের আন্দোলনে সর্বাগ্রে শামিল করিতে চাহিয়াছিলেন দলিত বা অন্ত্যজদের। মুসলিমদের জন্য সতত প্রসারিত রাখিয়াছিলেন তাঁহার আশ্রয়। তিনি জানিতেন না যে, ধর্ম-রাজনীতির কারবারিরা প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রে নামিয়া ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির পথ কিংবা সর্বমঙ্গলের ধারণাটিকে ছুড়িয়া ফেলিবেন, ধর্মের নামে বিভাজন দ্বারা নিজেদের প্রাধান্য রক্ষা করিবেন। গাঁধীর পর বিচিত্র বর্ণ-ধর্ম-সংস্কৃতি-ধন্য এই দেশে সকলের জন্য সুশাসনের রাজনীতি করিয়াছিলেন যে নেহরুরা, তাঁহারাও মানিতেন না যে, আদর্শকে পিছনে ফেলিয়া ক্ষমতার স্বার্থকেই সামনে আনা রাজনীতির প্রধান কর্তব্য হইতে পারে। রাজনীতির অগ্রাধিকারটি আজ পুরাপুরি উলটাইয়া গিয়াছে। গণতন্ত্রের এক ও একমাত্র আরাধ্য এখন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতা। আদর্শ ইত্যাদি নেহাত ছেলেমানুষি।

এই ভাবেই ভারতের গণতন্ত্র ক্রমশ সংখ্যাগুরুবাদে পরিণত হইতেছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে বিনাশের মাধ্যমেই সংখ্যাগুরুবাদ নিজেকে নিরাপদ করিতে পারে, তাই বহুত্বের বিনষ্টিযজ্ঞ প্রাত্যহিক ভাবে জারি থাকিতেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে একটি চূড়ান্ত অসাংবিধানিকতা আছে। কেননা ভারতের সংবিধানে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, সর্বজনীন ন্যায়বিচার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রধানত সমাজের যে চরিত্রটি রক্ষা করিবার কথা বলা হইয়াছিল, তাহার নাম— বহুত্ববাদ। বহুত্ব একটি নৈতিক মানদণ্ড: তাহাকে রাজনীতির সকল স্তরে প্রোথিত করাই ছিল সংবিধানের উদ্দেশ্য। গণতন্ত্র এখানে পথ-মাত্র, বহুত্বই গন্তব্য। সম্প্রতি রাহুল গাঁধীর মুখে এই কথার সামান্য আভাস শোনা গিয়াছে। নূতন নেতা তিনি, এখনও অনেক পরীক্ষা বাকি। তবু আশা রহিল, অনৈতিকতার বৃত্ত ছাড়িয়া নৈতিকতায় ফিরিতে তিনি প্রয়াসী হইবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pluralism Indian Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE