Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দুর্ভাগা দেশ

ভারতের আর্থিক অগ্রগতি বহুলাংশে অসম— অধিকাংশ নাগরিক তাহার ভাগ পান নাই, যাঁহারা পাইয়াছেন তাঁহারা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ।

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৭
Share: Save:

যাহাকে নীচে ফেলিয়াছ, সে নীচে বাঁধিবে— দেশের প্রতি কবির সেই বার্তা বৃথা হয় নাই। প্রতি বৎসর নূতন নূতন সমীক্ষা ভারতের সমাজে ঘোর ব্যবধান প্রকাশ করিতেছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ রিপোর্টে বলিয়াছে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিতে দরিদ্র, প্রান্তবাসীর অন্তর্ভুক্তির মাত্রা অত্যন্ত কম। অন্য ভাবে বলিলে, ভারতের আর্থিক অগ্রগতি বহুলাংশে অসম— অধিকাংশ নাগরিক তাহার ভাগ পান নাই, যাঁহারা পাইয়াছেন তাঁহারা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন উন্নয়নের মাপকাঠিতে ৭৪টি দেশের পরিস্থিতি বিচার করিয়াছে ফোরাম, সেই ৭৪টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ৬২তম। অপর একটি সমীক্ষা করিয়াছে আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থা ‘অক্সফ্যাম।’ তাহার ফলে প্রকাশ, ২০১৭ সালে ভারতে উৎপন্ন সম্পদের ৭৩ শতাংশ গিয়াছে এক শতাংশ মানুষের হাতে। এই অতিধনীদের ভাণ্ডারে যে সম্পদ যোগ হইয়াছে, তাহার অর্থমূল্য কেন্দ্রীয় সরকারের সংবৎসরের বাজেটের সমান। অপর দিকে, দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় এক বৎসরে এক শতাংশও বাড়ে নাই। বিষয়টি অনুধাবন দাবি করে। মোট জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে ভারতের অর্থনীতি অন্য অনেক দেশের তুলনায় বৃহৎ। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার পশ্চিমের বহু দেশকেও ছাড়াইয়াছে। কিন্তু নাগরিকের জীবনে কতটা পরিবর্তন আসিয়াছে?

দেশের মানুষ দেশের জাতীয় উৎপাদনে বৃদ্ধির হার দেখিয়া নিজেদের সমৃদ্ধির হিসাব করে না। পরিবারের শিক্ষা-স্বাস্থ্যে উন্নতি, রোজগার বৃদ্ধি, অধিক কাজের সুযোগ, এগুলি দিয়াই সমৃদ্ধির বিচার করে। অপর বিচার্য, অপরের সহিত পার্থক্য বা়ড়িল, না কি কমিল। সার্বিক দারিদ্রের তুলনায় সমৃদ্ধিতে অসাম্য সমাজে অধিক অশান্তির কারণ। দরিদ্রের জীবনযাত্রায় কী পরিবর্তন আসিয়াছে, সেই প্রশ্নের উত্তর মোট জাতীয় উৎপাদন বা অপর প্রচলিত সূচকে মিলিবে না। অথচ তাহার পরিমাপও প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যেই ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ তাহার সূচকে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সহিত রাখিয়াছে আরও দুইটি বিষয়, উন্নয়নে দরিদ্রের অন্তর্ভুক্তি, এবং প্রজন্ম হইতে প্রজন্মে ঋণভার (পারিবারিক ঋণ, পরিবেশ দূষণ, শিশু-বৃদ্ধদের প্রতিপালনের ভার, ইত্যাদি)। ভারত মন্দ ফল করিয়াছে বিশেষ করিয়া দরিদ্রের অন্তর্ভুক্তিতে। যদিও দেশে দারিদ্র কমিয়াছে, তবু দশ জনে ছয় জনই অতি সামান্য রোজগারে দিন গুজরান করিতেছে। সম্পত্তির মালিকানা বা রোজগার, কোনওটিই দরিদ্রের পরিবারে তেমন বাড়ে নাই। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ভারতের নীচে রহিয়াছে কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান সবার পশ্চাতে। এমনকী পাকিস্তান, যাহাকে হারাইবার আস্ফালন ভারতের জাতীয় বিনোদন, সেই প্রতিবেশী দেশটিও উন্নয়নে অসাম্যের নিরিখে ভারতের চাইতে উত্তম অবস্থানে রহিয়াছে।

অপর সমীক্ষাটিতেও প্রকাশ, ধনী-দরিদ্রে ব্যবধান বাড়িতেছে। একশো কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা একশো ছাড়াইয়াছে, তাহাদের সম্পদের পরিমাণও দ্রুত বাড়িয়াছে। তুলনায় দরিদ্রতম মানুষগুলির রোজগার বাড়িয়াছে অতি সামান্য। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি দেশের অধিকাংশ মানুষের কাজে লাগে নাই। আজ ভারতমাতার সম্পদের অভাব নাই, কিন্তু দরিদ্র সন্তানের প্রতি তিনি তেমনই বিমুখ। পরাধীনতার অপমান ঘুচিয়াছে, দুর্ভিক্ষের গ্লানি মুছিয়াছে, অধিকাংশ সন্তানের প্রতি বঞ্চনার অন্যায় ঘোচে নাই। লক্ষণীয়, ভারতে অসাম্য কেবল আর্থিক নহে, তাহা বহুমাত্রিক। শ্রেণি, জাতি, অঞ্চল, স্ত্রী-পুরুষ— বিভিন্ন দিক হইতে মানুষে মানুষে অবস্থা এবং অবস্থানের বিস্তর ফারাক। এবং সেই বিভিন্ন ধরনের ফারাক একে অপরকে বাড়াইয়া তোলে। যেমন, প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র আদিবাসী মেয়ে একই সঙ্গে অন্তত তিনটি কারণে সুযোগবঞ্চিত— তাঁহার বাসভূমি, তাঁহার জাতিপরিচয় এবং তাঁহার লিঙ্গপরিচয়। নিম্নবর্ণ, মুসলিম, দলিত-আদিবাসী, প্রান্তবাসী মানুষের প্রতি এই কার্পণ্য যত স্পষ্ট হইতেছে, তত জগৎসভায় ভারতের স্থানটি ম্লান হইতেছে। দাভোসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন উন্নয়নের উজ্জ্বল বৃত্তে বিশ্বকে আহ্বান করিতেছেন, তখন অসাম্যের কালিমা যেন পরিহাস করিতেছে। ধনীর প্রতি সীমাহীন প্রশ্রয়, দরিদ্রের প্রতি শূন্য প্রতিশ্রুতি, ভারতের এই পরিচয় তাহার প্রতি বিশ্বের আস্থা বাড়াইবে না। ভুলাইবার আশা বৃথা।

যৎকিঞ্চিৎ

সৌদি আরবে উটের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থেকে বারো জন উট-মালিক বহিষ্কৃত হল, কারণ সৌন্দর্য বাড়াতে তারা উটের মুখে বোটক্স ইঞ্জেকশন দিয়েছিল। এক জন আবার অপারেশন করিয়ে কানগুলোকে ছোট করার তালে ছিল। এ তো উটের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন, কারণ তার সম্মতি ছাড়া তার শরীর বদলাচ্ছ। আরও বড়: প্রসাধনী শল্য-হুজুগ ও রূপভিত্তিক মূল্যায়নের বদভ্যাস স্পিশিসান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্তে তীব্র পুংতন্ত্রের গন্ধ! মানুষ মেল-রা এ বার ক্যা-মেল’দেরও দলে চায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

WEF Economic Growth India Finance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE