Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

পরিণতি

এই ধারণার অনুষঙ্গেই ধরিয়া লওয়া হয়, রাজ্যসভা নির্বাচনের চরিত্রও হইবে লোকসভা হইতে স্বতন্ত্র— শান্ত, নিস্তরঙ্গ, নির্বিবাদ।

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কী ছিল বিধাতার মনে, সেই প্রশ্ন সর্বদাই কঠিন। কিন্তু স্বাধীন ভারতের সংবিধানখানি যখন প্রস্তুত হয়, তখন বোধ করি তিনিও জানিতেন না, দেশের রাজনীতিকরা সেই শাসনতন্ত্রের ফলিত রূপটির কী হাল করিতে চলিয়াছেন। আজ— সেই আশাতুর, আবেগকম্পিত সূচনালগ্নের প্রায় সাত দশক পরে ভারতীয় গণতন্ত্রের নিত্যকর্মপদ্ধতি দেখিয়া তিনিও নিশ্চয়ই হতবাক, যদি না তাঁহার বাক্ ইতিপূর্বেই হত হইয়া থাকে। সংবিধানপ্রণেতারা রাজ্যসভা নামক সংসদের ‘উচ্চতর’ কক্ষটি লইয়া বিস্তর ভাবিয়াছিলেন। প্রত্যক্ষ জনাদেশে নির্মিত লোকসভার পরে জনপ্রতিনিধিদের আরও একটি মণ্ডলী কেন সৃষ্টি করিতে হইবে, সেই প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজিয়াছিলেন। একাধিক উত্তর। এক দিকে সংসদে রাজ্যগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের স্বীকৃতি, অন্য দিকে লোকসভায় প্রণীত আইনগুলিকে রাজ্যসভার ‘প্রবীণতর’ সদস্যদের বিবেচনার আঁচে এক বার ঝালাইয়া লওয়া, এই দ্বিবিধ যুক্তিতেই সে দিন রাজ্যসভার ধারণাটি গৃহীত হয়। এবং এই ধারণার অনুষঙ্গেই ধরিয়া লওয়া হয়, রাজ্যসভা নির্বাচনের চরিত্রও হইবে লোকসভা হইতে স্বতন্ত্র— শান্ত, নিস্তরঙ্গ, নির্বিবাদ।

সে সকল বিগত শতাব্দীর ভাবনা। বিগত যুগেরও বটে। উন্নততর একবিংশ শতাব্দীতে রাজ্যসভা নির্বাচনের উদ্যোগপর্ব মহাভারতকেও হার মানাইয়াছিল, ভোটদিবসের ঘটনাবলি সতত কুনাট্যময় ভারতীয় রাজনীতিতেও নূতন নজির রচনা করিয়াছে। নীতি বা আদর্শের কথা হয়তো সমকালীন রাজনীতিতে অবান্তর, কিন্তু অন্তত আত্মসম্মান বা চক্ষুলজ্জার নিতান্ত দৈনন্দিন ধারণাগুলিও সেই রাজনীতির তাড়নায় কীরূপ অবান্তর হইয়া গিয়াছে, তাহার এমন নির্মম প্রদর্শনী বাস্তবিকই স্তম্ভিত করিয়া দেয়। অতিশক্তিশালী ও অতিসম্পন্ন বিরোধী দল পাছে ভাঙাইয়া লয়, সেই ভয়ে বিধায়কদের দল বাঁধিয়া ভিন্ন রাজ্যে ‘নজরবন্দি’ রাখা হইতেছে, এমন ঘটনা এই দেশে অতীতেও ঘটিয়াছে, কিন্তু তখন সংবাদমাধ্যমের এই প্রসার ছিল না, ফলে রাজনীতির কুমিরডাঙা জনসমক্ষে এতটা প্রকট হয় নাই। অথচ, এই উৎকট দৃশ্যাবলি দেখিয়াও নাগরিকরা বিশেষ চিন্তিত বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। তাঁহারা ধরিয়া লইয়াছেন, ইহাই ভারতীয় গণতন্ত্র। এই ধরিয়া লওয়াই গভীর উদ্বেগের কারণ। সমাজ যখন অনাচারকে স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া লয়, তখন অনাচার দূর করিবার আর কোনও তাগিদ থাকে না।

বস্তুত, অনাচার তখন ক্রমে নূতনতর মাত্রা পরিগ্রহ করে। মঙ্গলবারও তাহা দেখা গিয়াছে। কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনের নিকট দুই বিধায়কের ভোট বাতিলের দাবি জানাইবার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি সেই দাবির প্রতিবাদে কমিশনে পাল্টা দরবার শুরু করে। করিতেই পারে, বাদপ্রতিবাদ গণতন্ত্রের স্বভাবধর্ম। কিন্তু সেই প্রতিবাদ জানাইতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশের নির্বাচনে কমিশনের সম্মুখে হাজির হইবার কোনও স্বাভাবিক ব্যাখ্যা ছিল কী? রাজ্যসভার একটি আসনের জন্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের এই যুদ্ধকালীন তৎপরতা একটি সংশয়ই সৃষ্টি করে— তাঁহারা কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন। শেষ অবধি কমিশন কংগ্রেসের আবেদন মঞ্জুর করিয়াছে, সেই সিদ্ধান্তের কল্যাণে আহমেদ পটেল জয়ী হইয়াছে, এ সকলই ঘটনামাত্র, শ্রীযুক্ত পটেলের এই জয়ে তাঁহার বা তাঁহার দলের অন্ধকার ভবিষ্যৎ ঈষৎ উজ্জ্বলতর হইবে বলিয়াও ভরসা হয় না, কিন্তু সে সকল নিতান্ত গৌণ প্রশ্ন। মঙ্গলবার রাজ্যসভার নির্বাচনের ফল যাহাই হউক, যে বস্তুটি অপমানিত হইয়াছে, তাহার নাম সুস্থ স্বাভাবিক গণতন্ত্র। মোদী বাহিনীর মধ্যরাত্রির অভিযান দেখিয়া সংবিধান প্রণেতারা উদ্বেগ বোধ করিতে পারেন— তবে কি গণতন্ত্রের ভারত ছাড়িবার সময় হইল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

democracy India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE