ফাইল চিত্র।
ফল ভাল হইবে না, এই ভয়ে পরীক্ষায় বসিতেই যাহারা নারাজ হয়, উদ্বেগ-রোগে আক্রান্ত সেই ছাত্রছাত্রীদের কথা মনে হইতে পারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির হাবভাব দেখিয়া। গত কয়েক বৎসরে কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক দেশজোড়া সমীক্ষা-তালিকা বাহির করিতেছে, বিভিন্ন রকমের পরিসরে সেই সমীক্ষাগুলি সাধিত হইয়াছে, এ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সন্তর্পণে নিজেকে সে সকল পরিসর হইতে নিজেকে সরাইয়া রাখিয়াছে। ভাবটা এই রূপ— উহারা ইচ্ছা করিয়া আমাদের কম নম্বর দেয়, তাই উহাদের বয়কট করিব। অতি সম্প্রতি দেশের সর্বাধিক বাসযোগ্য শহরের হিসাব দিয়া একটি তালিকা প্রকাশ করিল কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহনির্মাণ ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রক। তাহাতে এক শত এগারোটি শহরের নাম থাকিল, পুণে ও নবি মুম্বই শীর্ষস্থান শোভিত করিল, দিল্লির ঠাঁই হইল অনেক নিম্নে, অথচ কলিকাতা যোগই দিল না! আবার, গত বৎসর স্বচ্ছ ভারতের প্রতিযোগিতায় কোন রাজ্য কেমন ফল করিয়াছে তাহার একটি তালিকা বাহির হইয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যে এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করে নাই।
কেবল তালিকা নহে। এই রাজ্য হইতে নানা ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান চাহিয়াও কেন্দ্রীয় সরকার বার বার হতাশ হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প, সর্ব ক্ষেত্রেই কাজের খতিয়ান দিবার বিষয়ে রাজ্য সরকারের প্রবল অনিচ্ছা। বুঝিতে অসুবিধা নাই, এই অনিচ্ছার ব্যাখ্যাটি হইবে রাজনৈতিক। তৃণমূল সরকারকে ‘ছোট’ করিয়া কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার রাজনৈতিক পয়েন্ট তুলিবে, এমন একটি আশঙ্কা এই অসহযোগিতার পিছনে। কিন্তু রাজনীতির অজুহাতের উপরে ও ভিতরে আসলে রহিয়াছে একটি বৃহত্তর মানসিক প্রবণতা। কোনও ভাবে তথ্য আদানপ্রদানের মঞ্চে না গিয়া নিজেকে দেশের মূলস্রোত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবার ইচ্ছা। কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত সহযোগিতা না করিবার মনোভাব। এই মনোভাব গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্যহীন।
বস্তুত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অংশ নিলে হয়তো এই নিতান্ত মধ্যমানের রাজ্য মোটের উপর ভাল ফলই করিত। যেমন বাসযোগ্য শহরের সমীক্ষায় কলিকাতা অংশী হইলে সম্ভবত বেশ ভাল নম্বরই পাইত। কিন্তু প্রতিযোগিতা হইতে পলাইয়া গেলে ভাল ফলই বা পাওয়া যায় কী করিয়া! আর একটি দৃষ্টান্ত স্মরণীয়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাণিজ্য সংক্রান্ত সংস্কার-এর জন্য অ্যাকশন প্ল্যান (বিআরএপি) সংক্রান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। ব্যতিক্রমী বলিতে হইবে সেই তালিকাকে, কেননা তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের নাম ছিল, এবং সেই নাম শীর্ষে স্থান পাইয়াছিল। বাণিজ্য পরিকাঠামো সংক্রান্ত সংস্কার-প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিবার হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ ৮৬ শতাংশেরও বেশি নম্বর পাইয়া ছত্রিশটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। সুতরাং, অসহযোগিতা ও কথোপকথনে বা আদানপ্রদানে অনীহা কেবল রাজ্যকে মন্দ রিপোর্ট হইতে ‘রক্ষা’ করে না, অনেক সময়ে ভাল রিপোর্ট হইতে বঞ্চিতও করে বইকি। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার অর্থ নিজেকে কেন্দ্রীয় শাসনের পরিসর হইতে সরাইয়া রাখা নহে, রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় রাখিয়া চলাই এই নীতির মূল প্রতিপাদ্য। রাজনৈতিক বৈরিতার যুক্তিতে সেই মূল নীতিটি হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখিলে তাহা নিতান্ত কুযুক্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy