Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জো হুজুর

জরুরি অবস্থারও প্রয়োজন নেই, এমনিই সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত

উপলক্ষটা সাদা চোখে কী? পরের দিন দু’দুটো ছবির মুক্তি। ‘উরি’ আর ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। ‘উরি’-র প্রধান অভিনেতা দলে ছিলেন। জয় হিন্দের ভিডিয়োতে দেখলাম, সব্বাই জনগণের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘কাল কিন্তু ‘উরি’ মুক্তি পাচ্ছে!’’

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৭
Share: Save:

আপাত ভাবে খুব জরুরি কোনও আলোচ্যসূচি ছিল না। কোনও অনুষ্ঠানও ছিল না। তবু ওঁরা মুম্বই থেকে উজিয়ে দিল্লি গেলেন। শুধু গেলেন না, বিমানে বসে সমস্বরে ‘জয় হিন্দ’ বলতে বলতে গেলেন। শুধু বললেন না, সেই সমবেত দেশভক্তির ভিডিয়ো টুইট করলেন। তার পর একগাল হাসি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজস্বী তুললেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন করার পুণ্য সঞ্চয় করলেন। খুশিতে ডগমগ করছিলেন ওঁরা। যেন ভারী একটা আমোদের ব্যাপার ঘটেছে। যেন দেশ জুড়ে আনন্দের বান ডেকেছে।

উপলক্ষটা সাদা চোখে কী? পরের দিন দু’দুটো ছবির মুক্তি। ‘উরি’ আর ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। ‘উরি’-র প্রধান অভিনেতা দলে ছিলেন। জয় হিন্দের ভিডিয়োতে দেখলাম, সব্বাই জনগণের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘কাল কিন্তু ‘উরি’ মুক্তি পাচ্ছে!’’

ঠিক! এটা জনগণকে সচকিত করার মতো একটা ব্যাপার বটে! পঠানকোট আর উরিতে হামলা ঠেকানো যায়নি তো কী! জবাবে সার্জিকাল স্ট্রাইক তো হয়েছে! নিন্দুকেরা যদিও বলেন, ও রকম স্ট্রাইক আকছারই হয়ে থাকে! কিন্তু সে সব নিশ্চয় ভুয়ো খবর! সরকার বাহাদুর যখন বলেছেন, এটা একটা যুগান্তকারী সাফল্য, আলবাত ঠিক বলেছেন। ৫৬ ইঞ্চি নিজে কী ভাবে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে জওয়ানদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন, ক’দিন আগেই সে কাহিনি টিভিতে শুনেছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। সেই ঐতিহাসিক ঘটনারই তো চিত্রায়ণ করেছে বলিউড। সবাই মিলে গিয়ে পূজনীয় প্রভুপাদে শরণ নিতে হবে না?

না, দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেউ দেখা করলে বা দেখা করে খুশি হলে সত্যিই কিছু বলার নেই। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও আপত্তির কিছু নেই। তা ছাড়া জনপ্রিয় ছবি এবং তাকে ধারণ করে যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, যার সঙ্গে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত, তাকে যে সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে হবে, এর মধ্যেও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। দরকার মতো সরকার যে সেই ইন্ডাস্ট্রিকে তার মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করবে, এমনকি তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই ছবিটা প্রায় এক। আর সার্বিক ভাবেও শিল্প-সংস্কৃতির জগৎটার একটা অংশ অন্তত হাওয়া-মোরগের মতো আচরণ করবে, সেটাও ধরে নেওয়াই যায়। নির্বাচনী প্রচারে তারকাদের আনা, ভোটে প্রার্থী করা, দলীয় অনুষ্ঠানে নক্ষত্রের হাট বসানো, এ সবও কিছু নতুন নয়। বিশেষত বঙ্গবাসী তো আজকাল এতেই বেশি অভ্যস্ত।

আরও পড়ুন: এই দেশে জন্ম নিক ভাঁওরি দেবীর মতো সাহসী মেয়েরা

তবু খটকা একটা লাগছে। তার কারণ, প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলের ঘনিষ্ঠ বলে যাঁরা ইতিমধ্যেই পরিচিত এবং সেই ঘনিষ্ঠতার ধারাবাহিক প্রকাশ যাঁদের মধ্যে দেখা গিয়েছে, দলটা ঠিক তাঁদের নিয়ে ছিল না। শুধুমাত্র ‘উরি’ বা ‘অ্যাক্সিডেন্টাল...’-এর কলাকুশলীদের নিয়েও ছিল না। বরং যাঁরা ছিলেন, যাঁরা একযোগে প্রধানমন্ত্রী সকাশে উৎফুল্ল হলেন, তাঁদের অনেককেই ওই বৃত্তে দেখতে অনভ্যস্ত ছিল চোখ।

না, এঁরা কেউ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পরাকাষ্ঠা ছিলেন না কোনও দিনই। তবু খটকাটা থেকে যাচ্ছে। কারণ এঁদেরই কেউ কেউ কিছু দিন আগে অবধি সংস্কারী সেন্সরশিপের দাপাদাপিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন। কেউ কেউ ‘নট ইন মাই নেম’ আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। এক জনের বাবা টুইট করে বলেছিলেন, ‘‘আমি গোমাংস খাই এবং খাব। কার তাতে কী?’’ এক জন অনেক দিন আগেই ‘মাই নেম ইজ় খান’ বানিয়ে গেরুয়া শিবিরের কোপে পড়েছিলেন। তার পর ফাওয়াদ খান কেন তাঁর ছবিতে অভিনয় করবেন, সেই প্রশ্নেও নাস্তানাবুদ হন। সে সব না হয় পুরনো কথা। কিন্তু মাত্র ক’দিন আগে অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলার দায়ে কিংবদন্তি অভিনেতাকে যে ভাবে ট্রোল করা হল, তাতেও, বোঝাই যাচ্ছে, এঁদের কিছু আসে যায়নি।

না যাওয়ারই কথা হয়তো। কারণ সে দিনের ওই নিজস্বী দেখিয়ে দিচ্ছে, ২০১৫-১৬’তেও বলিউড যেটুকু সাহস দেখাতে পারছিল, আজ তা আর নেই। দাদরি-পরবর্তী ভারতে তবু শাহরুখ-আমির মুখ খুলেছিলেন। বুলন্দশহরের পরে নাসিরুদ্দিনরা কার্যত একা। চলতি জমানায় গোটা দেশ জুড়ে যা যা ঘটে গেল, যে পরিমাণ সামাজিক হিংসা আর বিদ্বেষের বীজ বপন করা হল, যে পরিমাণ মিথ্যার ফানুস ওড়ানো হল, আজকের বলিউড, তাজা রক্তে টগবগে আর ছাঁচ-ভাঙা বলিউডের তা নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই! নইলে কোন মহৎ বার্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সমীপে হাজির হলেন তাঁরা? কর্ণ জোহরের টুইট বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার ‘অভাবনীয় সুযোগ’ সে দিন যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা সবাই মিলে ভারতের ‘ইতিবাচক রূপান্তর’ ঘটানোর ব্রতে শামিল হবেন। অর্থাৎ ভারত যে ইতিবাচক রূপান্তরের পথে হাঁটছে আর তার কান্ডারি যে বর্তমান চৌকিদার, সে বিষয়ে এই তরুণ বিগ্রেডের অন্তত কোনও সংশয় নেই।

এতটা নিঃসংশয় থাকার অভ্যেস কিন্তু বলিউডের ছিল না। ক্ষমতাসীনের সুরে সুর মেলানোর অভ্যেস ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপের সামনে কুর্নিশ করার অভ্যেসও ছিল। জনস্মৃতিতে জাগরূক হয়ে আছে— বালাসাহেব ঠাকরে যত দিন বেঁচে ছিলেন, বলিউড কী ভাবে পালা করে তাঁর দর্শনে যেত। কিন্তু ব্যতিক্রমের আলোকবিন্দুও একেবারে অনুপস্থিত ছিল না। জরুরি অবস্থার সময়েও নয়।

এ কথা ঠিকই যে, জরুরি অবস্থা জারির চার দিনের মধ্যে ইন্দিরার কাছে টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল: বলিউড তাঁর পাশে আছে। সঞ্জয় গাঁধীর ডাক পড়লেই জলসা মাতিয়ে আসতেন তারকারা। সরকারি প্রচারের অন্যতম কান্ডারি ছিল মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু কিশোরকুমার, দেব আনন্দ, প্রাণ, মনোজ কুমার, শত্রুঘ্ন সিন্হা গুলজার, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়রা অনেকেই সে দলে নাম লেখাননি। আকাশবাণী, দূরদর্শনে কিশোরকুমারের গানের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হলে চুপ থাকেননি মান্না দে, মহম্মদ রফি। সঞ্জয় গাঁধীকে তো

রফি বলে এসেছিলেন, ‘‘নেহরুর নাতি হয়ে এ আপনি কী করছেন?’’

বাক্যটি আলাদা করে খেয়াল করার মতো। কথাটা বলা হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন স্বাধীনতার ত্রিশ বছরও পেরোয়নি। নেহরু পরিবারকে নিয়ে আবেগ এবং আশার বাঁধন তখনও, খুব স্বাভাবিক নিয়মেই, বেশ উঁচু তারে বাঁধা। স্বাধীন ভারতে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ছবিতে সরকারি দফতর বা স্কুলের ক্লাসঘর মানেই দেওয়ালে গাঁধী-নেহরুর ছবি। তার পিছনে কিন্তু কোনও সরকারি ফরমান ছিল না। ওটা তখনকার সাধারণ রেওয়াজ, বাস্তবতাও।

সরকারি প্রণোদনায় চড়া দেশপ্রেমের ছবি তৈরি বা দেশভক্তির গান বাঁধার ব্যাপারে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ বরং একটা বড় সন্ধিক্ষণ। ‘হকিকত’ আর ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ’র আবেশ। কিন্তু আজ দেশে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই, জরুরি অবস্থার ঘোষণাও নেই। এতখানি আনতশির তবে কেন বলিউড?

শাহরুখ খান কিছু দিন আগে লিখেছিলেন, হলিউডে অভিনেতারা সরকারের সমালোচনা করলে, তাঁদের বাড়িতে ঢিল ছোড়া হয় না। তাঁদের ছবির মুক্তি আটকে যায় না। সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কেন এ দেশের তারকারা নীরব থাকেন, সেটা এ দেশের পরিস্থিতির সাপেক্ষে বুঝতে হবে। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে তা দিয়ে হয়তো নীরবতার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে দিন বলিউডের দলবল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যা করে এলেন, তাকে হালফিলের লব্‌জে বলা যেতে পারে, পিডিএ। পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন। তার ব্যাখ্যা মিলবে কিসে?

জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না, এটা বুঝতে অসুবিধা নেই। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কুমিরের কোল আলো করে বসে পড়াটাই নিয়ম হয়ে যাচ্ছে— ভাবলে একটু কেমন লাগে না? সঙ্কেতটা স্পষ্ট। এখন থেকে হুজুরের সামনে পড়লে সেলাম ঠোকা যথেষ্ট নয়। এত্তেলা এলে ‘হ্যাঁ স্যর’ বলে ছুটে যাওয়াটাও সব নয়। জরুরি অবস্থারও প্রয়োজন নেই। এমনি এমনিই সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে বলে আসছি, মন চাকর রাখ জি!

ইতিবাচক রূপান্তর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE