সত্যযুগের কথা নহে— ঘোর কলি এমন ঘোরতর হইবার পূর্বে, এই সে দিনও, মানুষ নিজের মনের মতো করিয়া নানা উৎসব করিত। যেমন বারোয়ারি দুর্গাপূজা। দল বাঁধিয়া, চাঁদা তুলিয়া, মণ্ডপ সাজাইয়া, ভোগ রাঁধিয়া, প্রম্পটার-প্রধান নাটক করিয়া বঙ্গবাসীর শারদীয় উৎসব উদযাপিত হইত। তে হি নো দিবসা গতাঃ। শারদোৎসব এখন ষোলো আনা বাণিজ্যিক উদ্যোগ। মুখ্যমন্ত্রী চাহিলেই তেলেভাজা বা বড়ি-আচারের পাশে এই উদ্যোগটিকেও বাংলার শিল্প-মানচিত্রে সগৌরব স্থান দিতে পারেন, এখনও কেন যে দেন নাই তাহাই এক বিস্ময়ের কারণ বটে। বস্তুত, এই উৎসব আজ আর ছোট বা মাঝারি মাপের বাণিজ্যে সীমিত নাই, ইহা আক্ষরিক অর্থেই বৃহৎ শিল্পে পরিণত— যাহাকে দেখিয়া মূঢ় জনে অবাক হইয়া প্রশ্ন করিতে পারেন: সত্যই এত বড়! দেবীর আরাধনায় বাণিজ্যের দাপট এমনই প্রবল হইয়াছে যে, এখন পূজার চাঁদা আদায়ের সেই প্রবাদপ্রতিম আড়ম্বরও প্রায় সম্পূর্ণ অন্তর্হিত, গৃহস্থ চাঁদা দিলেন কি দিলেন না, তাহাতে উদ্যোক্তাদের কাহারও কিছু আসে যায় না। তাহার কারণ সর্বজনবিদিত— পূজা এখন স্পনসরদের। পূজাপ্রাঙ্গণের প্রতিটি কোণে তাঁহাদের বিজ্ঞাপনী উপস্থিতি, পূজা উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিটি অনুষ্ঠান তাঁহাদের নামে চিহ্নিত, মায় মায়ের ভোগ অবধি কোনও না কোনও স্পনসরের নামাঙ্কিত। দেবীর অস্ত্রগুলির জন্যই কেবল এখনও ছাড় রহিয়াছে, বোধ করি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মুখ চাহিয়াই।
তর্কপ্রিয় বাঙালি বলিবে, তাহাতে ক্ষতি কী? পূজার খরচ আছে, সেই খরচ যদি স্পনসরদের তহবিল হইতে আসে, ভালই তো। চাঁদার উৎপাত কমিয়াছে, আরও ভাল। চাঁদার বদলে স্পনসর ধরিয়া টাকা আনিবার চাপ বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু তাহা আমজনতার জন্য নহে, কেষ্টবিষ্টুদেরই সেই চাপ সামলাইতে হয়, চাপের এই পুনর্বণ্টন গণতন্ত্রসম্মতও বটে। কথাটি ফেলিবার নহে। তবে তাহার পরেও কথা থাকে। সর্বজনীনতার কথা। সকলে মিলিয়া পূজা আয়োজনের যে ধারা চলিয়া আসিতেছিল, অনেক রকম অসাম্য এবং অত্যাচার সত্ত্বেও যাহা একেবারে অন্তঃসলিলা হয় নাই, স্পনসর-সর্বস্ব উৎসবের আতিশয্য অধুনা তাহাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করিতে চলিয়াছে, হয়তো বা ইতিমধ্যে পূর্ণগ্রাস সম্পন্ন হইয়াছে। বাঙালির দুর্গাপূজা এখন নামেই বারোয়ারি বা সর্বজনীন, তাহার আয়োজনে এখন বৈশ্যতন্ত্রের প্রবল পরাক্রম। যিনি যত টাকা দিতে বা আনিতে পারেন, তিনি পূজায় তত বড় মাতব্বর। এই তন্ত্রের সাধনা করিয়াই বিভিন্ন এলাকার রাজনীতিকরা এক একটি পূজার দখলদারি কায়েম করিয়াছেন— শাসক দলের রাজনীতিকদের সন্তুষ্ট রাখিবার তাগিদ অতি বিষম, ফলে গৌরী সেন জুটাইতে তাঁহাদের অসুবিধা নাই। কিন্তু বড় রাজনীতিকদের বাহিরেও নানা মাপের মাতব্বর আছেন, তাঁহারাই এখন শারদোৎসবের সর্বনিয়ন্তা। আমজনতা? যাহার নামে সর্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজন? সে এখন উপভোক্তা মাত্র। সমগ্র কর্মকাণ্ডে তাহার কোনও অবদান নাই, সে কেবল পঞ্চমী, চতুর্থী অথবা তৃতীয়া হইতে পূজা দেখিতে নামিয়া পড়ে। এই পরিণতি অনিবার্য ছিল। জীবনের বিভিন্ন পরিসরে মানুষ উপভোক্তায় পরিণত হইয়াছে, ইহাই আধুনিক বাজার অর্থনীতির মহিমা। শারদোৎসবই বা তাহার ব্যতিক্রম হইবে কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy