যাহা স্বাভাবিক, তাহাকে অ-স্বাভাবিক বলিয়া চিনিতে শিখিয়াছে এই যুগ। যথা, পূর্বে প্রাকৃতিক খাবারই স্বাভাবিক খাদ্য ছিল। কিন্তু অজৈব সার ও কীটনাশকের অতিরেকে প্রাকৃতিক খাদ্য ক্রমশ বিরল হইয়াছে। অতএব প্রচার করিতে হইতেছে: রাসায়নিক-লাঞ্ছিত খাবার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, অর্গানিক বা জৈব খাবার খাওয়াই শ্রেয়। রাসায়নিক-মুক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য এখন বিশেষ, অর্থাৎ অস্বাভাবিক। সম্প্রীতিও অনেকটা তেমনই। যে সম্প্রীতি সমাজে স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্যমান ছিল, এখন তাহার জন্য প্রচার করিতে হয়, তাহার দৃষ্টান্ত দেখিলে সেই দৃষ্টান্তের সাড়ম্বর প্রদর্শন করিতে হয়। কিছু কাল পূর্বে হাওড়ার কিছু এলাকায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির প্রবল আঁচ লাগিয়াছিল। সেই এলাকা হইতে কিয়ৎ দূরে এক গ্রামে একটি মন্দির নির্মাণ হইবে। তাহার খরচের একটি বড় অংশ দিয়াছেন এক যুবক, যিনি ধর্মে মুসলমান। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এই টাকা প্রদান করা হয় মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে। অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা একটি ফেসবুক গ্রুপ। তাঁহাদের উদ্দেশ্য— সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া। ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির পর এই গ্রুপটি তৈয়ারি হয়। এই ঘটনার প্রচার হইয়াছে।
সম্প্রীতির বার্তা প্রচার জরুরি। বিশেষত যখন ধর্মের নামে হানাহানি অবিরত। কিন্তু মেলাপ্রাঙ্গণে মঞ্চ বাঁধিয়া সম্প্রীতির বার্তা প্রচারের প্রয়োজন হইতেছে, ইহা কি দুর্ভাগ্যজনকও নহে? রাসায়নিক-মুক্ত খাদ্যের মতোই, বিদ্বেষ-মুক্ত সম্প্রীতি আজ ‘অ-স্বাভাবিক’। সেই কারণেই তাহার দৃষ্টান্ত সংবাদের শিরোনাম হইতেছে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু চির কাল এই দেশে পাশাপাশি বসবাস করিয়াছে। অশান্তি হইয়াছে, বিভেদ ঘটিয়াছে। আবার দুই পক্ষের স্থিতবুদ্ধি মানুষজনের মধ্যস্থতায় তাহা মিটিয়াও গিয়াছে। হিন্দু স্ত্রী পিরের দরগায় মানত করিয়াছেন, মুসলমান দুর্গাপূজায় প্রসাদ খাইয়াছেন। খরা-বন্যায় হাতে হাত মিলাইয়া লড়াই করিয়া টিকিয়া থাকিয়াছেন। ইহাই ছিল প্রাত্যহিকী। কিন্তু নিজ ধর্ম সম্পর্কে মানুষ ইদানীং অতিসচেতন। এবং সেই ‘সচেতনতা’ তাহার অন্তরের আধার উন্নত করে না, তাহার স্বভাবে অসহিষ্ণুতাকে এমন ভাবে খোদাই করে যে তাহার দ্বারাই মানুষ তাড়িত। অসহিষ্ণুতাই এখন ‘স্বাভাবিক’। পরস্পর সদ্ভাব রাখিলে, পারস্পরিক প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়াইলে তাহাকে সম্প্রীতির ব্যতিক্রমী নজির হিসাবে তুলিয়া ধরিতে হয়।
কেন এমন পরিস্থিতি? সংক্ষিপ্ত উত্তর: রাজনীতি। ধর্মাশ্রিত রাজনীতি, অধুনা যাহার প্রবল দাপট দ্রুত প্রবলতর হইতেছে। সেই রাজনীতি ধর্ম-সম্প্রদায়ের দূরত্বকে ব্যবহার করিয়া এবং বিকৃত করিয়া মুনাফা লুটিতে ব্যস্ত। দূরত্ব অতীতেও ছিল। কিন্তু এখন এক সম্প্রদায়ের মানুষ যাহাতে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়া উঠে, তাহার সচেতন রাজনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার। ইহারই নাম হইয়াছে মেরুকরণ। মেরুকরণ এখন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ। সাধারণ মানুষ এখন সেই রাজনীতির বোড়ে। সে ভোটার বেশি, মনুষ্য কম। ‘ধর্ম’ তাহাকে তাড়না করিয়া বেড়ায়। বিভেদই ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠে। এবং সম্প্রীতির সাড়ম্বর প্রচারের প্রয়োজন হয়। এই প্রচারে আপত্তির কোনও প্রশ্ন নাই। সম্প্রীতির প্রচার ভাল। তবে সেই প্রচারের প্রয়োজন না হওয়া আরও ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy