কানু বিনে গীত নাই। সরকারি ব্যবস্থায় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা অসম্ভব। অতএব, অসরকারি ব্যবস্থা ছাড়া নান্যঃ পন্থাঃ। অসরকারি বলতে অবশ্য প্রধানত দু’রকম, লাভজনক, এবং অলাভজনক। দেশে অলাভজনক শিক্ষা উদ্যোগ যৎসামান্য, বড় অংশটাই লাভজনক, যার সহজ নাম প্রাইভেট। সমাজ মেনে নিয়েছে। আমরা সেই সমাজের কথা বলছি যে সমাজের লোকদের কথার ওজন আছে, যাঁরা প্রভাব ফেলতে পারেন। এঁরা বলেন, সরকারি স্কুল অচল, ছেলেমেয়েকে যদি পড়াশুনো করাতেই হয়, তাদের প্রাইভেট স্কুলেই ভর্তি করতে হবে। প্রাইভেট-এর সুফলের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে আবার তুলে ধরা হয় তুলনামূলক সংখ্যা— জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মেডিক্যালে শতকরা ষাট, ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শতকরা আশি জনই পড়েছে প্রাইভেট স্কুলে।
বাজারে খবর ছিল, কলকাতার প্রাইভেট স্কুলগুলো বাড়াবাড়ি রকমের টাকা নেয়, তা নিয়ন্ত্রণে সরকার উদ্যোগী হচ্ছে। প্রাইভেট স্কুলের কর্তাকর্ত্রীদের সঙ্গে সরকারের, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর, যে বৈঠক হল তাতে কিন্তু অধুনা সুপরিচিত সরকারি দাপটের কিছুমাত্র দেখা গেল না। খানিকটা বাবা-বাছা করে, খানিকটা আবেদনের ভঙ্গিতে তাঁদের বলা হল, একটু দেখুন, ফি একটু কম করুন, এত টাকা লোকে দেবে কী করে, ইত্যাদি। অর্থোপার্জনের প্রতিযোগিতায় নামা প্রতিষ্ঠান নিজেই নিজেকে মুনাফার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রিত করবে, এমন কাঁঠালের আমসত্ত্ব পরিবেশন করে বৈঠক শেষ!
উন্নত বিশ্বে বহু দেশে অল্পবিস্তর প্রাইভেট স্কুল আছে। তার কারণটা শিক্ষার গুণমানের সঙ্গে বিশেষ যুক্ত নয়, এবং সে সব স্কুল শিক্ষার ব্যাপারে কোনও বিভাজন সৃষ্টি করে না। কিন্তু ভারতে প্রাইভেট স্কুলের সমগ্র কার্যকারণটাই সামাজিক বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত। চড়া কাঞ্চনমূল্য দিতে না পারা হাসিম শেখ রামা কৈবর্তদের সন্তানরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটুকুও দেখতে শিখবে না। একটা গোটা দেশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবে আর কতিপয় সুবিধাভোগী সেই বঞ্চনার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে, এমন বাজারের গুণমুগ্ধরা এই অশ্লীলতায় লজ্জা না পেয়ে গৌরবান্বিত। তাঁদের সাফ কথা, যার সাধ্য আছে সে যদি প্রাইভেটকে বেছে নেয়, তা হলে কার কী বলার? না, কিছু বলার থাকত না যদি দাবিটা এই হত যে, সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই যথার্থ গুণমান নিশ্চিত করা হোক, তার পর যে যার মতো বেছে নেবে। কিন্তু দাবিটা হচ্ছে: সরকারি ব্যবস্থাটা চলবে না, সুতরাং হাসিম শেখ রামা কৈবর্তদেরও প্রাইভেটের দিকে টেনে আনতে হবে। সেটা হচ্ছেও। তাঁদের এমন সঙ্গতি নেই যে ছেলেমেয়েদের জয়েন্টে পাশ করানোর নিশ্চয়তা দেওয়া স্কুলে ভর্তি করবেন। সুতরাং গঞ্জে-গলিতে গজিয়ে ওঠা নানা মাপের, নানা মানের প্রাইভেট স্কুলে তাঁদের সন্ততিরা পিটুলিগোলা গিলছে। যেটুকু হিসেব পাওয়া যায়: ২০০৪ সালে দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় অসরকারি অংশ ছিল শতকরা ২০; এক দশকে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫।
যাঁরা শিক্ষাতেও খোলা বাজারের কথা বলেন, তাঁরা বেছে বেছে এটা ভুলে যান যে, মুক্ত বাজারের পীঠস্থান আমেরিকায়, জাপানে, এবং অন্যত্র বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষাদানের প্রায় সবটাই সংগঠিত হয় সম্পূর্ণত সরকারি উদ্যোগে। দক্ষিণ এশিয়ার ছবিটা সঙ্গের তালিকায় স্পষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রাইভেট স্কুলের অংশ বিচারে ভারত ও পাকিস্তান বিশ্বসেরা!
ঘটনা হল, আজ শিক্ষায় অগ্রগামী প্রতিটি দেশ প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করেছে, তার পর ওপরের দিকে গিয়েছে। জাপান, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড— সব দেশেরই এক ইতিহাস। যুক্তিটা ছিল, সংসাধন সীমিত, তাই আগে গোড়াটাকে মজবুত করতে হবে, সে দায় সরকারের। সরকার যদি দায় না নেয়, তা হলে বহু শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে, সেটা হতে দেওয়া চলে না। সরকার প্রকৃত দায়িত্ব নেওয়ার ফলে সব শিশু যে সমতাপূর্ণ এবং যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষা পেল সেটাই উচ্চশিক্ষার ভিত গড়ে দিল। ভারত-পাকিস্তান নিল উল্টো পথ, যাদের স্বার্থ সর্বাগ্রে সুরক্ষিত করা দরকার, তাদের কথা না ভেবে শিক্ষাকে কতিপয় বিত্ত-ক্ষমতাবানের একাধিকারে পরিণত করা হল। ঔপনিবেশিক শাসন কালে, ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শনের সূচনা’তে বঙ্কিম এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করে বলেছিলেন, ‘‘এক্ষণে একটা কথা উঠিয়াছে, এডুকেশন ফিল্টর ডৌন করিবে। এ-কথার তাৎপর্য এই যে, কেবল উচ্চ শ্রেণীর লোকে সুশিক্ষিত হইলেই হইল, অধঃশ্রেণীর লোকদিগকে পৃথক শিখাইবার প্রয়োজন নাই; তাহারা কাজে কাজেই বিদ্বান হইয়া উঠিবে।... বিদ্যা জল বা দুধ নহে যে, উপরে ঢালিলে নীচে শোষিবে।’’
বঙ্কিমের ব্যঙ্গ, বিদ্যাসাগরের উপদেশ, রবীন্দ্রনাথের তিরস্কার, কিছুতেই কিছু হয়নি। আজও দেশে এক-চতুর্থাংশ লোক নিরক্ষর। অথচ এ দেশেরই এক রাজ্য কেরল, এবং আমরা যার অক্ষম প্রতিযোগী, সেই প্রতিবেশী চিন, সর্বজনীন শিক্ষার, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করে সরকারি ভাবে সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। অন্য লাভ হোক বা না হোক, কেবল শিখবার জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন আছে, পাশাপাশি শিক্ষার অন্য লাভও কম না: অর্থশাস্ত্রীরা হিসেব কষে দেখিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় যে ব্যয় করা হয় তা থেকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উৎপাদনশীলতা বাড়ে যথাক্রমে ২৭ ও ১৯ শতাংশ।
শিক্ষাক্ষেত্রটাকে তথাকথিত মুক্ত বাজারের কবল থেকে মুক্ত করার যে সুযোগ এই রাজ্য পেয়েছিল, তা গ্রহণ করার বদলে, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলার যথেষ্ট রসদ থাকা সত্ত্বেও তাকে কাজে না লাগিয়ে, রামা কৈবর্ত হাসিম শেখ এবং তাবৎ বঙ্গদেশের প্রতি অবিচার ও বিশ্বাসভঙ্গ করেই চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy