Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ভালবাসা

গণপরিসরের উপর অধিকারের প্রশ্নটিকে কী ভাবে দেখা বিধেয়? ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার যেমন চরিত্রে নেতিবাচক— গণপরিসরের অধিকারও সেই গোত্রের।

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

কলিকাতার সারমেয়প্রেমীরা জন লিলি-র দ্বারস্থ হইতে পারেন। দুনিয়ার ইতিহাসে ষোড়়শ শতকের ব্রিটিশ সাহিত্যিক লিলি-র একটি বিশিষ্ট অবদান আছে। তাঁহার ইউফিউইজ: দি অ্যানাটমি অব উইট গ্রন্থে একটি কালজয়ী বাক্য ছিল: ‘প্রেমে ও যুদ্ধে সকলই বৈধ’। গত পাঁচশতাধিক বৎসরে বাক্যটির বহু ব্যবহার ও ততোধিক অপব্যবহার হইয়াছে। কলিকাতার কুকুরপ্রেমীরা না হয় আরও এক বার করিবেন। কারণ, শহরের পরিসরটিকে কুকুরদের মুক্তাঙ্গনে পরিণত করিলে অ-কুকুরপ্রেমী নাগরিকের যে অধিকারভঙ্গ হয়, তাহাকে অন্য কোনও যুক্তিতে বৈধ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। লেডি ব্রেবর্ন কলেজে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নির্দেশ জারি করিয়াছিলেন, কলেজের পরিসরে কেহ পথকুকুরকে খাওয়াইতে পারিবেন না। নির্দেশ অমান্য করিলে মোটা জরিমানা হইবে। তুমুল প্রতিবাদের পর নির্দেশটি প্রত্যাহার করা হইয়াছে। কিন্তু, প্রশ্নটি যায় নাই। কলেজের সব ছাত্রী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীই সমান কুকুরপ্রেমী হইবেন, ধরিয়া লইবার কারণ নাই। দন্তরাজি বিকশিত করিয়া কুকুর ছুটিয়া আসিলে অনেকেরই আত্মারাম খাঁচা ছাড়িবার উপক্রম করে। কুকুরের কামড়ে বা আদরেও— প্রত্যেকের অভিরুচি নাই। কলেজের পরিসরটিকে কুকুরদের জন্য খুলিয়া রাখিলে এই মানুষগুলির তুমুল অসুবিধা। এক দলের কুকুরপ্রেম রক্ষা করিতে অন্য, সম্ভবত বৃহত্তর, জনগোষ্ঠীর অসুবিধা তৈরি করা কি বৈধ হইতে পারে?

গণপরিসরের উপর অধিকারের প্রশ্নটিকে কী ভাবে দেখা বিধেয়? ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার যেমন চরিত্রে নেতিবাচক— গণপরিসরের অধিকারও সেই গোত্রের। অর্থাৎ, সেই পরিসরে প্রতিটি মানুষের কিছু অধিকারকে কোনও অবস্থাতেই লঙ্ঘন করা চলে না। যেমন, অবাধ বিচরণের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার। যে কারণে গণপরিসরে ধূমপান অন্যায়, এবং বহু জায়গাতেই বেআইনি, ঠিক সেই কারণেই কুকুর লইয়া আদিখ্যেতাও অন্যায়। কারণ, তাহাতে অন্য কাহারও গণপরিসরের অধিকার খণ্ডিত হয়। সারমেয়পন্থীরা ব্যথিত প্রশ্ন করিতে পারেন: কুকুর বলিয়া তুচ্ছ? যে পরিসরে মানুষের অধিকার আছে, সেখানে কুকুরেরই বা অধিকার থাকিবে না কেন? একমাত্র উত্তর: যেখানে কুকুরের অধিকারের সহিত মানুষের অধিকারের প্রত্যক্ষ সংঘাত, সেখানে মানুষকে অগ্রাধিকার না দিয়া উপায় নাই। শহরের গণপরিসরকে কী ভাবে কুকুর বা অন্যান্য পশুপ্রাণী হইতে মুক্ত রাখা যায়, তাহা সভ্য সমাজের বিবেচ্য হওয়া বিধেয়।

এই অবস্থানের সহিত পশুর প্রতি সদয় হওয়ার কোনও বিরোধ নাই। কলিকাতা পুরসভা মাঝে-মাঝে যে ভঙ্গিতে কুকুর ধরিতে পথে নামে, তাহাকেও সমর্থন করিতে হইবে না। শুধু মানিতে হইবে, শহরের পরিসরকে কুকুরমুক্ত রাখা আবশ্যক, এবং তাহার একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা সন্ধান করিতে হইবে। যাঁহারা পশু ভালবাসেন, তাঁহাদের সেই অধিকার বিলক্ষণ আছে। কিন্তু, সেই ভালবাসাকে ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন। নিজের বাড়িতে যত খুশি কুকুর পুষুন, তাহাদের খাইতে দিন, তাহাদের সঙ্গে আহ্লাদ করুন। কিন্তু, সেই ভালবাসাকে পথে নামাইলে মুশকিল। শহরের পথঘাট মানুষের জন্য থাকুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dog Lover constitution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE