Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কৃষির সমস্যা অতি কঠিন

ঠিক কী ভাবে যে এ-সব হত, তা ঠিক ভাবে কেউই জানে না, কারণ এদের ইতিহাস লেখার কোনও প্রশ্নই কোনও দিন ওঠেনি।

অরূপরতন ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ১৩:৩৭
Share: Save:

হঠাৎ কৃষি নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ও চিন্তাভাবনা করতে আরম্ভ করেছেন। আজ নয়, শত শত বছর ধরে কৃষি নিয়ে ছেলেখেলা চলছে। শুধু রকমফের ঘটেছে। আগে রাজা বা জমিদার কৃষকের কাছ থেকে প্রয়োজনের অনেক বেশি শস্য কর বাবদ আদায় করে নিতেন যাতে তাঁদের মধ্যে একটা অভাবের বা অনটনের অবস্থা বজায় থাকে, যাকে বলা যায় সাসটেনেবল পভার্টি— সুস্থায়ী দারিদ্র। এর পর ওই শস্যের অংশবিশেষ মাঝে মাঝে খরা বা বন্যা বা অন্য কোনও উপলক্ষে কৃষকের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন (এখন যেমন ভর্তুকি দেওয়া হয়) ও মহানুভব সাজতেন বা কর্তৃত্ব বজায় রাখতেন (এখন যেমন ভোটব্যাংক বজায় রাখেন)। এর ফলে তাঁরা নিজেরা ও তাঁদের পারিষদবর্গ ক্রমশ বিত্তবান ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠতেন, অবশ্যই রাজ্যচালনার ও উন্নতির নামে। নতুন, আরও বড় রাজবাড়ি, মন্দির, কত কী তৈরি হত, আর চাষিরা সেই একই আবস্থায় থেকে যেত। কেউ কেউ জমিদার বা নায়েবের নেকনজরে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত (এখন যেমন পার্টির ক্যাডার হওয়ার চেষ্টা চলে), দু’এক জন পাইক-বরকন্দাজ হওয়ার বা সেনাবাহিনীতে নাম লেখানোর চেষ্টা করত, বাকিরা সেই চূড়ান্ত গরিবি ও হতাশায় দিন কাটাত।

ঠিক কী ভাবে যে এ-সব হত, তা ঠিক ভাবে কেউই জানে না, কারণ এদের ইতিহাস লেখার কোনও প্রশ্নই কোনও দিন ওঠেনি। আর তখন তো টিভি, কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল, এ সব কিছুই ছিল না, তাই এক রাজার অত্যাচারের খবর অন্য রাজ্যে পৌঁছত না। তবে মূল আচরণবিধি বোধ হয় একই রকম ছিল।

এখন একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক, এই ছেলেখেলা কেন এখনও কার্যত একই ভাবে চলছে। এবং সব থেকে বড় কথা, দেশের বা সমাজের এই খেলা আমাদের ক্রমশ খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, চাষি-বিক্ষোভ, চাষি-মৃত্যু ক্রমশ বড় আকার নিচ্ছে। বিদেশি আর্থ-সামাজিক নীতি বা চলে আসা ভর্তুকি নীতি দিয়ে এ সব আর সামলানো যাবে না।

এই ছেলেখেলা যে এখনও একই ভাবে চলছে, তার প্রমাণ— এক দিকে বিজয় মাল্য ইত্যাদি আর এক দিকে চাষির আত্মহত্যা, এক দিকে সপ্তম বেতন কমিশন আর এক দিকে চাষির ফসলের ন্যায্যমূল্য না-পাওয়া, এক দিকে গাড়ি-বাড়ির ক্রমবর্ধমান বিক্রি আর এক দিকে নতুন প্রযুক্তির অভাবে, লোকসানের চাপে চাষ বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম।

এক বার ভাবুন তো, আমরা, দেশের ২০ শতাংশ মানুষ কি শুধু আমাদের রান্নাঘরের সুরক্ষায় ব্যস্ত? অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার তুলনায় কৃষিপণ্যের মূল্যস্তর ক্রমশ কমলে আমরা খুশি হই, কারণ আমাদের খরচ কমে। কিন্তু তাতে কৃষকের আয় যে কমে যায়, তা নিয়ে তো আমরা ভাবি না। শুধু সবজির (বিশেষত পেঁয়াজ, আলু) মূল্যবৃদ্ধির হার এই এক বছরে ১০.৮ থেকে -১৩.৪ তে নেমে গেছে। ভাবুন আর বোঝার চেষ্টা করুন, চাষিরা কেন আন্দোলনের পথে, তারা কী নিয়ে এগোবে, কী ভাবে বাঁচবে।

তা হলে কী করা যায়? কঠিন প্রশ্ন, উত্তর দেওয়া আরও কঠিন। কিন্তু সব থেকে কঠিন হবে উত্তরগুলো মেনে নেওয়া, বিশেষ করে যাঁদের কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বা যাঁরা লাভের খোঁজে প্রচুর মূলধন নিয়ে সবেমাত্র কৃষিতে পা রেখেছেন তাঁদের পক্ষে। তবুও এক এক করে উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করা যাক। তবে কৃষির যথার্থ উন্নতির পথ সন্ধানের আগে অর্থনীতি ও উন্নতির সংজ্ঞার পুনর্বিবেচনা জরুরি। উন্নতি মানেই শিল্প, কৃষি মানেই পিছিয়ে যাওয়া— এই ভুল নীতি চলবে না।

জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অংশ, জনসংখ্যায় কৃষকের অনুপাত— এ সব উন্নত দেশের মতো করে ক্রমাগত কমিয়ে নিয়ে যাওয়া ভারতের আর্থিক নীতি হতে পারে না। বিশেষ করে আগামী দিনের নিরিখে, যেখানে সারা পৃথিবীতে কৃষি, জল, ও জ্বালানি হবে ব্যবসার বড় আধার। তাই আমাদের উৎপাদনে কৃষির অংশ এবং জনসংখ্যায় কৃষকের অনুপাত বিষয়ে একটা ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। এবং সেটা যথাক্রমে ২০ ও ৫০ শতংাশের এর নীচে যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। এই দুটোর একটা সুসামঞ্জস্য স্থাপন করা খুবই জরুরি। এটা না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা বা বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী। সব থেকে বড় কথা, অর্থনীতির ওই ‘ফোঁটা ফোঁটা তত্ত্ব’ (পারকোলেশন থিয়োরি) কৃষিক্ষেত্রে আপাতত কোনও ভাবেই কাজে আসবে না। ফসলের দাম বাড়ুক বা কমুক, অধিকাংশ চাষি মার খেয়েই চলবেন।

এই প্রাথমিক কথাটা মাথায় রেখে আমরা কৃষির উন্নতির জন্য কয়েকটি প্রস্তাব করতে পারি।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE