তবু: ২০১৪ সালে একটিও আসন পাননি, কিন্তু মায়াবতীর নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত আছে।
রাজনীতিতে ‘ভোটব্যাঙ্ক’ আজ এক জনপ্রিয় শব্দ। ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানের অ্যারিস্টটল বলা হয় যে এম এন শ্রীনিবাসকে, প্রয়াত সেই বেঙ্গালুরুবাসীই ছিলেন এই শব্দটির জন্মদাতা। ভারতের স্বাধীনতার আগে থাকতেই নানা ধরনের জনগোষ্ঠীর সমর্থন ছিল কংগ্রেসের। ধীরে ধীরে বিগত ৭০ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরও সমর্থকভিত্তি গড়ে উঠেছে। অতীতে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাত-ধর্ম ভিত্তিক এই জনভিত্তি থাকলেও তাকে ভোটব্যাঙ্ক বলা হত না। এখন এই কট্টর আনুগত্যর নাম ভোটব্যাঙ্ক।
এ বার উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে লালুপ্রসাদ যাদবকে জেলে পুরলেও তাঁর ভোটব্যাঙ্ককে জেলে পোরা য়ায়নি। ২০১৪ সালে মায়াবতী একটিও আসন না পেলেও বহুজন সমাজ পার্টির ভোটব্যাঙ্ক আজও অক্ষুণ্ণ।
ভারতের রাজনীতি, ষড়যন্ত্রী মশাইদের লীলাখেলা! ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি ২৮২টি আসন লাভ করেছিল শতকরা মাত্র ৩১ ভাগ ভোট নিয়ে। অতএব প্রায় সত্তর ভাগ ভোট অ-বিজেপি জোটের ভোটব্যাঙ্ক। অসাধু প্রচারের ঢক্কা নিনাদের চোটে এই তথ্যটা আড়ালে চলে গেল। আমরাও যেন নিজেদের চোখ সরিয়ে রেখেছিলাম। চার বছর পর গুজরাতের ধাক্কা, উপনির্বাচনের ফলাফলের পর হঠাৎ এখন দেখছি, কখন যেন বিজেপির আসনসংখ্যা কমতে কমতে ২৮২ থেকে হয়ে গিয়েছে ২৭৪।
এই ২৮২টি আসনের চিৎকার এক কুহকের জন্ম দিয়েছিল। আমরা ভুলতে বসেছিলাম, অখণ্ড শক্তিশালী ভারত নির্মাণের উচ্চারণের আড়ালে একই ভাবে বেঁচে আছে এ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্নতা। অনেক ভাষা, নানা জাতের, নানা বর্ণের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য। অতীতে এক দীর্ঘ সময় ‘কংগ্রেস সিস্টেম’ এই যাবতীয় ভিন্নতাকে সঙ্গে নিয়ে চলত। তারপর, সত্তর দশকে সেই কংগ্রেস নামক শক্তিশালী ব্যবস্থাটি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল। ভারতে এল জোট-যুগ। ’৭৭ সালে, ’৮৯ সালে এবং তার পরও দেবগৌড়া-গুজরালের জোটযুগ আমরা দেখেছি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ও ছিল বিজেপির নেতৃত্বে আর এক বিকল্প জোটের সময়। জোট মানে এ দেশের নানা আঞ্চলিক দল। মানে গোটা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্নতা।
মোদীর চার বছরের শাসনের পর এখন বলতে পারি, মোদী নামক এক প্রবল পরাক্রান্ত নেতৃত্বের মোকাবিলা কোনও একটি রাজনৈতিক দলের দ্বারা একক ভাবে সম্ভব নয়। প্রয়োজন মোদীবিরোধী জোট। যদি মোদীবিরোধী কোনও সর্বসম্মত ফ্রন্ট গঠন সম্ভব হয় ২০১৯-এর লোকসভার আগেই, যদি উপনির্বাচনের জোটধর্ম বজায় রেখে মায়াবতী এবং অখিলেশ ঐক্যবদ্ধ থাকেন, তবে কিন্তু মোদী সরকারের বিপদ নিয়ে কোনও প্রশ্নই থাকবে না। ষোড়শ লোকসভায় বিজেপির সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এসেছিল উত্তরপ্রদেশ আর বিহার থেকেই। তাই ২০১৯ সালে এই দুটি রাজ্য থেকে বিজেপিকে আরও অনেক বেশি ভাল ফল করতে হবে, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কার্যত অসম্ভব। অবাস্তব।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, উত্তরাখন্ডের মত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে স্থানীয় অসন্তোষ প্রবল। বিধানসভা ভোট আসন্ন কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে। ওই সব রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা কমার সম্ভাবনা প্রবল। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির কৌশল সুপরিচিত: ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে যদি জাত-পাত ভিত্তিক ভোটব্যাঙ্ক ভাঙা সম্ভব হয়। কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ত্রিপুরা, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে
যদি হিন্দুত্ব-প্রচারকে মূলধন করে আসন বাড়ানো সম্ভব হয়। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, বিজেপির শতকরা ভোট ধীর গতিতে বাড়লেও আঞ্চলিক দলগুলির নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক আজও বিজেপি ভাঙতে পােরনি। তামিলনাড়ুতে এডিএমকে বা ডিএমকে-র মত দ্রাবিড় দলের দ্বি-দলীয় মেরুকরণে বিজেপির শক্তি কতটুকু?
বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস বলছে, ১৯২৫ সালের আরএসএস, ’৫১ সালের জনসংঘ এবং ’৮০ সালের বিজেপির প্রধান পরিচয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দল, কিন্তু বাস্তবে সংঘ চির কাল উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের হাতেই বন্দি ছিল। আজ পর্যন্ত আরএসএস কি কোনও দলিত-হরিজনকে সংঘচালক করতে পেরেছে? নির্বাচনী রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় আজ দলিত কর্মীর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন করে স্বাধীনতার ৭০ বছর পর মোদী-অমিত শাহ বার্তা দিতে চাইছেন যে তারা অবিভক্ত হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের আনুগত্য পেতে চান। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিজেপিতে যাদব নেতা থাকলেও যাদব ভোট বিজেপির ঝোলায় আসছে না। সেটি যাচ্ছে লালু আর অখিলেশের ঝোলাতেই।
১৯৩৫ সালে অম্বেডকর প্রথমে ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি গঠন করেন। তার পর ১৯৪২ সালে তিনি দলিতদের জন্য গড়েন শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন। ’৫৬ সালে রিপাবলিকান পার্টি। শুধু দলিত নয়, তাঁর লক্ষ্য ছিল, এ দল হবে সব নিম্নবর্গের মানুষের জন্য। ’৫৭ সালে অম্বেডকর মারা যান। তার মানে ভোটব্যাঙ্ক নির্ধারণ করা নিয়ে অম্বেডকরের দোলাচল ছিল। কাঁসিরামও কিন্তু উত্তরপ্রদেশে প্রথম থেকেই শুধু দলিত নয়, চামার ও অন্যান্য নিম্নবর্গকেও যুক্ত করেন তাঁর আন্দোলনে। মায়াবতী তো আরও এগিয়ে মুসলমান ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের একাংশকেও তাঁর ভোটব্যাঙ্কে সামিল করেন। ফলে সব রাজনৈতিক দলই চায়, তার নিজস্ব অনুগামী ভোট ব্যাঙ্ক যাই থাক না কেন, সেই ভিত্তিকে আরও প্রসারিত করতে। মায়াবতী যেমন সেটা করতে চেয়েছেন, বিজেপিও হিন্দু ভোটকে সুসংহত করতে চেয়ে দলিত-ওবিসি-নিম্নবর্গ এমনকী জাঠ-যাদবকেও কাছে টানতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অন্য আঞ্চলিক দলের ভোটব্যাঙ্কের মৌরসিপাট্টা ভাঙা সহজ কাজ নয়।
বিজেপি গত চার বছরে একদলীয় শাসনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভারতের নানা রঙের কসমোপলিট্যানিজমকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। নিছক দেশাত্মবোধ অনেক সময় এক রঙের হয়, কিন্তু জাতীয়তাবাদে থাকে নানা রঙ, নানা ভাষা, নানা খাদ্যাভাস, নানা আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য। এখন বোঝা যাচ্ছে এক দলীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী অখণ্ড শাসনের আড়ালে থেকে গিয়েছে নানা খণ্ড জাতীয়তাবাদী ভোট ব্যাঙ্ক। মোদীর অখণ্ডতার শাসনে তারা তেড়েফুঁড়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
২০১৯-এর আগে মানুষের তিক্ততায় সমাচ্ছন্ন মনের পরিচয় পেয়ে মোদীর মতো কৌশলী নেতা ঠিক কী ভোট-কৌশল অবলম্বন করবেন, তা এখনও অজানা। এত সহজে বিরোধী শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেবে না বিজেপি। তবে মোদীবিরোধী নেতারা যদি অভিজ্ঞতার আগুনে পুরনো জোট রাজনীতির প্রত্যয়কে আর এক বার ঝলসে নেন, তবে কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে আবার নড়তে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy