Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
যদি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ হই, এখন তার প্রমাণ দেওয়ার পালা

আত্মগ্লানি হয়, কেন প্রতিবেশীর ঘরে ঢুকিনি কোনও দিন

মেটিয়াবুরুজ বা মাটির দুর্গে লখনউ থেকে বিতাড়িত অবধের কবি, নর্তক, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি কাটান। তিনি মেটিয়াবুরুজে গড়ে তোলেন ‘ছোটা লখনউ’।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১৩
Share: Save:

কলকাতায় সম্প্রতি ‘নো ইয়োর নেবার’ বা ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ নামে একটি সাধু উদ্যোগ চালু হয়েছে। এই প্রয়াসের উদ্যোক্তা মূলত কিছু মুসলিম যুবকের নেতৃত্বে তৈরি-হওয়া একটি সংস্থা। এই প্রয়াসে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি এক রবিবার সকাল সকাল আমরা বেশ কিছু কলকাতাবাসী মেটিয়াবুরুজ বেড়াতে এবং সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলাম। ‘মেটিয়াবুরুজ ভ্রমণ’ শুনলে যত আশ্চর্যই লাগুক না কেন, দেখা গেল, আমরা টালিগঞ্জ, যাদবপুর, কসবা, প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী শহরের মধ্যবিত্ত বাবু-বিবিরা বেশির ভাগই এর আগে মেটিয়াবুরুজে তেমন ভাবে ‘পায়ের ধুলো’ দিইনি। মেটিয়াবুরুজ বা মাটির দুর্গে লখনউ থেকে বিতাড়িত অবধের কবি, নর্তক, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি কাটান। তিনি মেটিয়াবুরুজে গড়ে তোলেন ‘ছোটা লখনউ’।

না, এ-লেখার উদ্দেশ্য মেটিয়াবুরুজ কিংবা ওয়াজিদ আলি শাহের ইতিহাস বর্ণনা নয়।
এ-লেখা আত্মগ্লানির। জন্ম এবং কর্মসূত্রে আদ্যন্ত কলকাত্তাইয়া হয়ে, পাশের পাড়ায় থেকে, এমনকী স্কুলকলেজের দিনগুলিতে নিয়মিত গার্ডেনরিচ রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে মামার বাড়িতে ছুটি কাটিয়েও, কখনও ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ সিবতায়নাবাদ ইমামবড়া দেখতে যাইনি। কখনও বিচালিঘাটের রাস্তায় মনিহারি দোকানগুলো থেকে ‘শপিং’ করিনি, কখনও ইউনিভার্সিটির বন্ধু মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা শামিমের বাড়ি যাইনি। শুধু মেটিয়াবুরুজ কেন, কলেজের বন্ধু শেখ সুজাউদ্দিনের এন্টালির বাড়িতে যাইনি, পার্কসার্কাসে জেঠুর বাড়ি গেছি কত বার, জানবাজারে হিন্দু বান্ধবী শর্মিষ্ঠার বাড়িও অসংখ্য বার, অথচ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানারও চেষ্টা করিনি, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি প্রতি পঁচিশে বৈশাখ সকালে গিয়ে কালচারের অনুশীলন করেছি, কিন্তু পাশের পাড়ায় নাখোদা মসজিদ যাইনি। তালিকা আরও লম্বা করা যায়, কিন্তু তাতে বুকের ভেতর এতোলবেতোল বাড়বে বই কমবে না।

কথা হচ্ছে, কেন যাইনি? শুধু আমি তো না, আমরা অনেকেই যাইনি। কিন্তু একেবারেই কি যাইনি? ভেবে দেখলুম, গিয়েছি তো! খিদিরপুর-মেটেবুরুজের যৌনকর্মীদের পাড়ায় গিয়েছি সমাজসেবা করতে, নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন বস্তিতে গিয়েছি মেয়েদের ভোটের অধিকার নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতে, পার্কসার্কাসের বস্তিতে গিয়েছি মেয়েদের গার্হস্থ্য হিংসা থেকে বাঁচাতে, রাজাবাজারের মুসলমান পাড়ায় মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করাতে গিয়েছি। গভীর পাপবোধের সঙ্গে ভেবে দেখি, এ-তালিকাও লম্বা। মুসলমান, নির্দিষ্ট লবজে বললে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মেয়েদের ‘অন্ধকার থেকে আলোয়’ নিয়ে আসার অধিকার আমাদের, অর্থাৎ গঙ্গোপাধ্যায়, চট্টোপাধায়, ঘোষ, বোস, মিত্র, মুখুজ্জেদের যেন জন্মগত অধিকার। কিন্তু কে দিল আমাদের এই অধিকার? কোন অধিকারে আমরা তাঁদের ঘরে ঘরে গিয়ে বলি— বোরখা হল ‘পিছিয়ে থাকা’ নারীর আবরণ? কোন অহংকারে তাঁদের জীবনযাপন, তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে ওপর-পড়া হয়ে পরামর্শ দিই? কোন স্পর্ধায় মেটিয়াবুরুজের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষের অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁদের বাড়ির ছবি তুলি? আজ ভাবনার অতল গভীরে ঢুকে বুঝতে পারি, এ-অহংকার হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের অহংকার।
এ-স্পর্ধা ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরুর স্পর্ধা। এই স্পর্ধারই মাত্রাছাড়া প্রকাশ দেখা যায়, যখন মোদীজি মুসলমান মেয়েদের ‘উদ্ধার’ করতে একান্ত ব্যগ্র হয়ে পড়েন, এই স্পর্ধারই চরম অভিব্যক্তি দেখি, যখন যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুসলমান মেয়েদের দুঃখে কুম্ভীরাশ্রুপাত করেন।

ফেরা যাক ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর কথায়। লক্ষণীয়, ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর উদ্যোগ করেছেন মুসলমান সমাজ। আমরা, উচ্চ বর্ণের হিন্দু, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ কিন্তু এ-উদ্যোগ করিনি। সত্যি কথা স্বীকার করা দরকার, আসলে আমরা ভাবিইনি যে, ‘ওরা’ আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশী তো হয় সমানে সমানে। আমরা ওদের ‘উদ্ধারকর্তা’, আমরা ওদের ‘উন্নয়ন’-এর স্বআরোপিত দায়িত্বে, আমরা ওদের ‘আহা’ ‘উহু’ করব, দয়া-ধর্ম করব, মুসলমান ছাত্রছাত্রী ভাল রেজাল্ট করলে পিঠ চাপড়াব, মুসলমান পরিচিত মানুষ বাড়িতে এলে চা দেব, কিন্তু সেই চায়ের কাপ লুকিয়ে আলাদা করে রাখব (এ ব্যাপারটা অবশ্য গরিব মুসলমানের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য), কিন্তু ‘ওরা’ আমাদের পাশের বাড়ির লোক? প্রতিবেশী? ছোঃ, তা কী করে হয়!

প্রায় দু’বছর হয়ে গেল, ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ উদ্যোগটি চলছে পশ্চিমবঙ্গে। সারা রাজ্যে, যদিও বেশির ভাগই কলকাতায়, গোটা কুড়ি সভা হয়ে গেল। কিন্তু সবই ওই মুসলমান যুবকদের উদ্যোগে। ওদেরই তো দায় ওদের চেনানোর! ওদেরই দায় ওদের পাড়ায় আমাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে, আদরযত্ন করে, প্রমাণ করার— ‘ওরা’ আমাদেরই মতন শান্তিপ্রিয় ভেতো বাঙালি! মুসলমান সমাজেরই তো দায় আমাদের মনে মুসলমান সম্পর্কে সব বিকৃত ‘মিথ’গুলো ভাঙানোর! ঠিক যেমন করে আজকের ভারতে মুসলমান নাগরিককে প্রতিপদে প্রমাণ দিতে হয় যে, সে ভারতবাসী, বিরাট কোহালিকেই সে দেশের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন জ্ঞানে পুজো করে, ২৬শে জানুয়ারি তারও প্রজাতন্ত্র দিবস, তেমন করেই মুসলমান পাড়ায় জোড়হস্তপূর্বক, ‘আসুন দাদা’, ‘বসুন দিদি’ করে আমাদের অর্থাৎ হিন্দু উচ্চ বর্ণের নাগরিকদের নিয়ে গিয়ে তাদের প্রমাণ দিতে হয় যে, মুসলমান মেয়ে মানেই বাচ্চা জন্ম দেওয়ার যন্ত্র নয়, মুসলমান পুরুষমাত্রই গোটা পাঁচেক বিয়ে করে বসে নেই, মুসলমানদের ঘরদোরও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন হয়, রাজাবাজার-খিদিরপুরের মানুষও বদহজমে পটলডাঙার প্যালারামের মতো শিঙি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খায়, মুসলমান ঘরের বাচ্চাও গোগ্রাসে ফেলুদা গেলে, মুসলমান পাড়া মানেই অপরাধী তৈরির কারখানা নয়!’ এবং, হ্যাঁ, ‘মুসলমান’ আর ‘বাঙালি’ আলাদা নয়! পশ্চিমবঙ্গে জন্মানো, এই বাংলার জলহাওয়ায় বড় হওয়া মুসলমানও নিজ অধিকারে বাঙালি!

লজ্জায় ঘাড় ঝুঁকে যায় এই ভেবে যে, আমরা সাবির আহমেদ, মহম্মদ আনোয়ার, আমিরুল আলম, মহম্মদ রিয়াজদের আমাদের পাড়ায় ডাকিনি। আমরা হেদুয়া, সিমলা, বিবেকানন্দ রোড কিংবা গোলদিঘির ধারে ওদের হেরিটেজ ওয়াক করানোর কথা ভাবিওনি। আমরা দক্ষিণেশ্বর মন্দির বা কালীঘাটের ভোগ খেতে আমন্ত্রণ করিনি বন্ধু সাবির, ভ্রাতৃসম রিয়াজ বা প্রিয় লেখক শামিমকে। আমরা কোনও আলোচনাসভা করিনি আমাদের চেনানোর জন্য। আমরা এ-সব কিছুই করিনি, কারণ আমাদের নিজেদের প্রমাণ করার কোনও দায় নেই। আমরা এ-দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুবিধাভোগী নাগরিক। আমাদের প্রতিভূ এ-দেশের সরকারে আসীন। অতএব আমাদের কিসের পরোয়া?

কিন্তু এই যদি আমাদের অবচেতন অন্তরের মনোভাব হয়, তা হলে আর যা-ই হই, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ নই। আমাদের মধ্যেও প্রচ্ছন্ন ধারায় হিন্দুত্ব বহমান। যদি সত্যিই আজ আমরা প্রতিবেশীকে চিনতে চাই, যদি টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ, শ্যামবাজার, রাজাবাজার, পার্কসার্কাসের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে চাই, তা হলে প্রথমে আত্মসমালোচনার হোমানলে নিজেকে শুদ্ধ করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, সংখ্যায় যারা বেশি, তাদেরই দায় বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার, তাদেরই আগে ঘরের দুয়ার খোলা উচিত ছিল, যা আমরা করিনি। কিন্তু সময় যায়নি। দেরি হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও আমরা শুরু করতে পারি। আমরা যদি যথার্থই ধর্মনিরপেক্ষ হই, তা হলে এখন আমাদের প্রমাণ দেওয়ার পালা। আত্মম্ভরিতা পরিহার করে, কলুটোলা, মেটিয়াবুরুজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, এ বসন্তে শহরের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষজনকে পাড়ায় ডেকে আমাদের গাওয়ার পালা— আজি দখিন দুয়ার খোলা/এসো হে...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Secularism Communal harmony
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE