Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ভোটের বাজারে সওদা করা সহজ নয়

পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত থাকেন না বলেই ক্রেতারা ঠকে যান। ভোটের বাজারও সেই রকম। প্রার্থী সম্বন্ধে সম্যক ধারণার অভাবে নির্বাচনে ভুল হয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান কিন্তু অসম্ভব নয়।দুটি ঘটনা। ঘটনার স্মৃতি। প্রথমটি লোকাল ট্রেনে। এক ভদ্রলোক তাঁর সহযাত্রীকে বলছিলেন, ‘অনেক আশা করেছিলাম এ বার যদি কিছু ভাল হয়, কিন্তু তিন বছর কেটে গেল, যে কে সেই, অমুকবাবুও হতাশ করলেন।’ বুঝেছিলাম, রাজ্য রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, পরিবর্তনকামী ভদ্রলোক হতাশ হয়েছেন। দ্বিতীয়টি বিমানবন্দরে। সিঙ্গাপুরগামী বিমানের এক যাত্রী তাঁর সহযাত্রীকে বলছিলেন, ‘ক’বছর তো দুর্নীতি সামলাতেই কেটে গেল, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, দেখা যাক এ বার কী হয়।’ বুঝলাম, বিষয় জাতীয় রাজনীতি, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশার টানাপড়েন চলছে।

বিশ্বজিৎ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

দুটি ঘটনা। ঘটনার স্মৃতি। প্রথমটি লোকাল ট্রেনে। এক ভদ্রলোক তাঁর সহযাত্রীকে বলছিলেন, ‘অনেক আশা করেছিলাম এ বার যদি কিছু ভাল হয়, কিন্তু তিন বছর কেটে গেল, যে কে সেই, অমুকবাবুও হতাশ করলেন।’ বুঝেছিলাম, রাজ্য রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, পরিবর্তনকামী ভদ্রলোক হতাশ হয়েছেন। দ্বিতীয়টি বিমানবন্দরে। সিঙ্গাপুরগামী বিমানের এক যাত্রী তাঁর সহযাত্রীকে বলছিলেন, ‘ক’বছর তো দুর্নীতি সামলাতেই কেটে গেল, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, দেখা যাক এ বার কী হয়।’ বুঝলাম, বিষয় জাতীয় রাজনীতি, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশার টানাপড়েন চলছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা স্বপ্ন দেখি, আশা করি, সিদ্ধান্ত নিই। নির্বাচনের পরে ক্রমে আশাভঙ্গ হয়, ক্ষুব্ধ হই। ভাবতে চেষ্টা করি, কোথায় ভুল করলাম, কেন ঠিকঠাক প্রার্থী বাছাই করতে পারলাম না।

‘ভোটের বাজার’ কথাটা সুপ্রচলিত। ক্রেতারা যেমন বাজার থেকে পণ্য বাছাই করে কেনেন, বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে ভোটদাতাকে তেমনই নিজের প্রতিনিধি বাছাই করতে হয়। বাজার সব সময়েই কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে না, সে কথা আমাদের অজানা নয়। ক্রেতা ঠকে যেতে পারেন, ভোটদাতাও। ঠকে যাওয়ার পিছনে মূল সমস্যাটা একই: যথেষ্ট তথ্যের অভাব। পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত থাকেন না বলেই ক্রেতারা ঠকে যান। প্রার্থী সম্বন্ধে ধারণা কম থাকায় বা ভুল ধারণা থাকায় নির্বাচনে ভুল হয়ে যায়। তাই যথাযথ পণ্য বা প্রার্থী নির্বাচনে সাহায্য করার জন্য তথ্যের এই অপ্রতিসাম্য (অ্যাসিমেট্রি) দূর করা জরুরি। ক্রেতাকে তথ্য জানানোর জন্যই তো এত বিজ্ঞাপন, এত গ্যারান্টি। আবার ভোটদাতাকে তথ্য সরবরাহ করার উদ্দেশ্যেই এত নির্বাচনী প্রচার, প্রতিশ্রুতির প্লাবন। কিন্তু বিজ্ঞাপনে কিংবা প্রচারে ছলনা থাকতে পারে, অর্থাৎ তথ্যের অপ্রতিসাম্য কমা দূরে থাকুক, আরও বেড়ে যেতে পারে, তার ফলে ক্রেতা বা ভোটদাতা বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাতে সমাজের ক্ষতি, গণতন্ত্রেরও।

এই প্রেক্ষিতেই ভোটপ্রার্থী তথা রাজনীতিকদের সম্পর্কে যথাযথ তথ্যের সরবরাহ কী করে বাড়ানো যায়, সেটা দেখা দরকার। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের, বিশেষত নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগী হওয়া উচিত। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু এ দেশে তো বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন লেগেই থাকে, তাই যে কোনও সময়েই চেষ্টাটা শুরু করা যেতে পারে, ক্রমশ সেই উদ্যোগ পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়ে উঠবে। কী ভাবে এগোনো যায়, সেটাই প্রশ্ন।

দ্রব্য বা পরিষেবার বাজারে যেমন গ্যারান্টি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যায়, সেটা রাজনীতিতে সম্ভব নয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের কাজকর্মের মূল্যায়নের ভিত্তিতে তাঁদের সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণায় উন্নতি ঘটানো যেতে পারে। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘সিগনালিং’ বা ‘স্ক্রিনিং’। সবার আগে অবশ্য আমাদের স্মৃতিকে আর একটু সবল করে তোলা দরকার, কোন প্রতিনিধি কেমন কাজ করেছেন সেটা সহজেই ভুলে গেলে আমাদেরই তার মাসুল গুনতে হবে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থীদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কয়েকটি উদ্যোগের কথা ভাবা যায়।

এক, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয়, আর্থসামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ তথ্য মনোনয়নপত্র দাখিল করার সময় নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। মূল নিয়মটি এখন আছে, কিন্তু তাকে আরও জোরদার করা দরকার এবং এই সব তথ্য নাগরিকদের বিশদ ভাবে জানানোর ব্যবস্থা করা দরকার। এই ধরনের তথ্য দু’এক বছরের জন্য দেওয়া যথেষ্ট নয়, অন্তত গত দশ বছরের খোঁজখবর নাগরিকদের জানানো দরকার। তা হলে তাঁরা প্রার্থীর জীবনযাপন, সততা এবং কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কিছুটা স্পষ্ট ধারণা করতে পারবেন। জনস্মৃতি সচরাচর দুর্বল হয়ে থাকে, তাই সেই স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকা চাই।

দুই, দলীয় ইস্তেহার ছাড়াও প্রত্যেক প্রার্থীকে তাঁর নির্বাচনী এলাকার জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি জানাতে হবে। কমিশনের অনুমোদন পাওয়ার পরে সেই কর্মসূচি এলাকার সমস্ত ভোটদাতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে প্রার্থীকে, যাতে নির্বাচনের আগে ভোটদাতারা যথেষ্ট সময় নিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রতিশ্রুতিগুলি তুলনা করে দেখতে পারেন। ফাঁকা প্রতিশ্রুতি বা কর্মসূচি দিলে চলবে না, সেগুলি রূপায়ণের বিশ্বাসযোগ্য রূপরেখা পেশ করতে হবে।

তিন, আগের নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থী যদি আবার ভোটে দাঁড়ান, তা হলে আগের বারের প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পেরেছেন, না পারলে কেন পারেননি, সে সব বিষয়ে বিশদ বিবরণ জমা দিতে হবে। সাংসদ বা বিধায়ক কোটার কত টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, তার হিসেব দেওয়ার একটা ব্যবস্থা এখন আছে বটে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। এমন নিয়ম চালু করা দরকার যে, মোট বরাদ্দ অর্থের একটা ন্যূনতম নির্ধারিত অংশের সদ্ব্যবহার করতে বা প্রতিশ্রুতির একটা ন্যূনতম অংশ পূরণ করতে না পারলে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। বরাদ্দ অর্থের সদ্ব্যবহার বা প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্পর্কে তথ্য পরিসংখ্যান নিরপেক্ষ ভাবে যাচাই করে দেখার দায়িত্ব নিতে পারে নির্বাচন কমিশন নিজেই বা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত কোনও স্বাধীন সংস্থা।

চার, প্রত্যেক প্রার্থীর অতীতে কমিউনিটি সার্ভিস-এর মতো জনসেবার কাজে অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্ব থাকা দরকার। সেই কাজের খতিয়ান সংবলিত শংসাপত্র মনোনয়নপত্র দাখিল করার সময়েই পেশ করা এবং তার পর জনসমক্ষে প্রকাশের নিয়ম করা দরকার। স্থানীয় মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেই খতিয়ান মিলিয়েও দেখতে পারবেন। এতে প্রথমত জনগণ প্রার্থীর সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যাঁরা ভবিষ্যতে ভোটপ্রার্থী হতে চান, তাঁরাও সময় থাকতে কমিউনিটি সার্ভিসে উৎসাহী হবেন। দেশে সামাজিক উদ্যোগের প্রসার ঘটবে।

যে সব সম্ভাব্য সমাধানের কথা আমরা আলোচনা করলাম, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আয়োজন দুটি। কোন মাত্রায় প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারলে গত বারের বিজয়ী প্রার্থী আবার ভোটের ময়দানে নামতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র তথা নির্বাচন কমিশনের। প্রতিশ্রুতি পূরণের মাত্রার উপরে এলাকার তথা দেশের উন্নয়ন নির্ভর করবে, তাই মাত্রাটা পর্যাপ্ত হওয়া আবশ্যক।

দুর্নীতির প্রশ্নটাও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশে অদূর ভবিষ্যতে দুর্নীতি সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে বলে মনে হয় না, তাই দুর্নীতি কমানোটাই আপাতত লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই প্রেক্ষিতে ধরে নিতে পারি, এক জন বিজয়ী প্রার্থী আগামী পাঁচ বছরের জন্য কী লক্ষ্য স্থির করবেন, তার দু’ধরনের সম্ভাবনা আছে। এক দল হয়তো মনে করেন যে পরের নির্বাচনে আবার টিকিট পাওয়ার বা টিকিট পেলেও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাঁরা জেতার পর থেকে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ তাঁদের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বেশি এবং কাজ কম হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অন্য দিকে থাকবেন লম্বা দৌড়ের খেলোয়াড়রা, তাঁরা সম্ভবত অনেক বেশি উন্নয়নী প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে হয়তো অল্পস্বল্প ‘উপার্জন’-এর রাস্তাও খুলে রাখবেন, কারণ, ওই যে বলেছি, দুর্নীতি সম্পূর্ণ বন্ধ করার ভরসা না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবু, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা যদি প্রতিশ্রুতি পূরণের উপর নির্ভর করে, তা হলে ধরে নেওয়া যায়, অল্পস্বল্প দুর্নীতি সত্ত্বেও এই দ্বিতীয় দলের প্রার্থীদের কল্যাণে উন্নয়নের কাজ কিছুটা এগোবে।

বাস্তবসম্মত ভাবে ধরে নেওয়া যায়, অনেক বিজয়ী প্রার্থীই যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবেন না, সুতরাং পরের বার টিকিট পাবেন না। তার ফলে নতুন প্রার্থী আসবেন। প্রতি নির্বাচনে নতুন নতুন জনপ্রতিনিধি উঠে আসার সম্ভাবনা বাড়বে। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন প্রার্থীদের কাজের ইচ্ছা এবং উদ্যম বেশি থাকে। তাতে দেশের মঙ্গল। আবার উল্টো দিকে, ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা তাগিদ থাকে, মোহ থাকে। সেই আকর্ষণে সবাই কম-বেশি প্রতিশ্রুতি পালনের চেষ্টা করবে, এটাও অন্যায় প্রত্যাশা নয়।

বিশ্বভারতীতে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE