গুলিবিদ্ধ: তখনও বেঁচে আইটিআই পড়ুয়া রাজেশ সরকার। বৃহস্পতিবার ইসলামপুরের দাড়িভিটে। নিজস্ব চিত্র
পুলিশি ব্যবস্থা কি আদ্যন্ত পরিহাসের নামান্তর হয়ে উঠছে এ রাজ্যে? ইসলামপুর কাণ্ডের পরে খুব জোরালো ভাবে উঠে আসছে এই প্রশ্ন। নিছক অকর্মণ্যতা? নাকি নিষ্ঠুর মিথ্যাচার? পুলিশি ব্যবস্থার নামে কী চলছে বাংলায়, বোঝা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে!
গুলিতে দুই ছাত্র খুন হয়ে যাওয়ার পরে কেটে গেল প্রায় দু’দিন। কিন্তু কার গুলিতে মৃত্যু হল রাজেশ সরকার আর তাপস বর্মণের, পুলিশ জানাতে পারল না। পুলিশ বলল যে, পুলিশ গুলি চালায়নি। পুলিশ আরও বলল যে, জমায়েতের মধ্যে দুষ্কৃতীরা সামিল হয়েছিল অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং তারাই গুলি চালিয়েছিল। তা হলে কি দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতেই খুন হয়ে গেলেন দুই পড়ুয়া? পুলিশ এ প্রশ্নের কোনও মিমাংসায় গেলই না। সবই তদন্ত সাপেক্ষ বলে জানিয়ে আপাতত দায়মুক্ত হতে চাইল।
কিন্তু এত সহজে তো দায়মুক্ত হওয়া যায় না। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখাই পুলিশের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। সর্বত্র সব সময় পুলিশ থাকবে না, কিন্তু পুলিশের প্রতি সমীহ কাজ করবে আর মূলত তাতেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে— পুলিশি ব্যবস্থা এই রকম একটা ধারণার উপরে ভিত্তি করেই কাজ করে। কিন্তু ইসলামপুরের দাড়িভিট গ্রামে যা ঘটল, তা পুলিশ সম্পর্কে কোনও প্রচলিত কোনও ধারণার সঙ্গেই মেলে না। পুলিশের অনুপস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা হয়েছে সেখানে, এমন নয়। যা হয়েছে,তা পুলিশের উপস্থিতিতেই হয়েছে। খুব কম সংখ্যক পুলিশ নয়, বেশ কয়েকটি থানা থেকে বাহিনী এনে বিক্ষোভের মোকাবিলা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ফল কী দাঁড়িয়েছে? দু’টি তরতাজা প্রাণ বেঘোরে ঝরে গিয়েছে। আরও অনেকে জখম হয়েছেন। যে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগকে ঘিরে গোলমাল, সেই স্কুল ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গিয়েছে। বিশাল পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও এমনটা কী ভাবে ঘটতে পারে? একে পুলিশের চূড়ান্ত অকর্মণ্যতা তথা অপদার্থতা বলা হবে না কেন?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা অকর্মণ্যতা বা অপদার্থতা সংক্রান্ত নয়। বড় প্রশ্নটা হল— যা কিছু ঘটল, সবই পুলিশের সামনে ঘটল, প্রকাশ্য স্থানে ঘটল, দিনের আলোয় ঘটল, তা সত্ত্বেও পুলিশ বুঝতেই পারল না যে, কারা গুলি চালাল, কোন দিক থেকে চালাল, কেন দুটো তরুণ প্রাণ এমন অকালে ঝরে গেল? একাধিক থানা থেকে পুলিশ বাহিনী সমন্বিত হয়েছিল দাড়িভিটেয় বৃহস্পতিবার। অত বড় বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও বোঝাই গেল না যে, প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে বেরিয়ে গেল কারা? এ কথা বিশ্বাসযোগ্য?
এই সরকারকে কিন্তু স্পষ্ট জবাবটা দিতে হবে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল তত্কালীন বিরোধী দল তৃণমূল। ‘ট্রিগার হ্যাপি’ সরকারকে উত্খাতের ডাক দিয়ে গোটা রাজ্যে তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল তৃণমূল। গত সাত বছরে কী এমন হল যে, তৃণমূলের সরকারই এ বার ‘ট্রিগার হ্যাপি’ সরকার হিসেবে প্রতিভাত হতে শুরু করল? তৃণমূল তথা সরকারের নেতৃত্বকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
আরও পড়ুন: দুই শিক্ষকের কথায় প্রভাবিত হয়েই কি ঝাঁপিয়েছিল পুলিশ? নীরব এসপি
গুলিচালনার অভিযোগ প্রসঙ্গে অবশ্য একটা নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফরাক্কা, ঢোলাহাট, ভাঙড়, পুরুলিয়া, ইসলামপুর— পর পর এতগুলি জায়গায় জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রিগারে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ গুলিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কোথাও বলেছে, শূন্যে গুলি চালানো হয়েছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলেছে গুলি চালানোই হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে গুলি কে চালাল? পুলিশ জানিয়েছে, দুষ্কৃতীরা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছিল, তারাই গুলি চালিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ক’জনকে ওই সব ‘গুলিচালনা’র অভিযোগে গ্রেফতার করা হল, তার কোনও স্পষ্ট হিসেব পুলিশ দেয়নি।
এ এক নতুন প্রবণতা বাংলায়। পুলিশের বিরুদ্ধে বার বার গুলিচালনার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ বার বার অভিযোগ অস্বীকার করছে। কিন্তু গুলি যে চলেছে এবং গুলিতেই যে মৃত্যু হয়েছে, সে কথা অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের হাতে থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুটে আসার তত্ত্ব সামনে আসছে। কোনও ক্ষেত্রে কিছু ধড়পাকড় হচ্ছে, কোনও ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না। তবে যাঁরা ধরা পড়লেন, তাঁরা গুলিচালনার বা খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হলেন কি না, সে কথাও স্পষ্ট করে জানা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: জেলা প্রশাসনের পরামর্শ মানেননি স্কুলকর্তা, রিপোর্ট ডিএমের
এতগুলি ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠল। একটি ক্ষেত্রেও কি পুলিশকে তদন্তের মুখে দাঁড় করানো হল? হল না। পুলিশকে তদন্তের মুখে দাঁড় করানো কিন্তু কর্তব্য ছিল তৃণমূল সরকারের। কারণ আগের সরকারকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ আখ্যা দিয়েই রাজ্যের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ঢেউ তুলেছিল সে সময়ের বিরোধী দল তৃণমূল। সেই তৃণমূল আজ শাসন ক্ষমতায়। সেই তৃণমূলের জমানায় খুব অল্প একটা সময়কালের মধ্যেই এত বার গুলি চালানোর অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রেও পুলিশকে তদন্তের মুখে দাঁড়াতে হচ্ছে না। পুলিশ শুধু ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, গুলি কোন বন্দুক থেকে এল, তা তদন্তসাপেক্ষ। সে তদন্ত কোন পথে এগোচ্ছে, কতটুকু এগোচ্ছে, আদৌ কোনও দিন শেষ হবে কি না কারও জানা নেই।
এ প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বার বার পুলিশের উপস্থিতিতে গুলি চলবে, এক দল বলবেন গুলি পুলিশই চালিয়েছিল, পুলিশ বলবে গুলি অন্য কেউ চালিয়েছিল, কিন্তু সেই ‘অন্য কেউ’টা কে বা কারা, সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না— এই লক্ষণ মোটেই শুভ নয়। যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত অশুভ লক্ষণ এটা। জনআন্দোলনের যাবতীয় প্রচেষ্টা আটকে দিতে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা নয়তো? এই প্রশ্নও কিন্তু উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন দিক থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy